বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সবার অগোচরে শহর সাজান যেসব নারী

  •    
  • ৮ মার্চ, ২০২২ ০৮:২৪

গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমের কোলে, নগরের জঞ্জাল সাফে তখন ব্যস্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাদের বেশির ভাগই নারী। কীভাবে তারা কাজ করেন, রাত জেগেও কী করে সামাল দেন ঘর-সংসার তা অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা।

রিজিয়া বেগমের দিন শুরু হয় রাতে। ভোররাতে নগরবাসী যখন গভীর নিদ্রায় ডুবে, রিজিয়া তখন ব্যস্ত নগর সাজাতে।

রাজধানীতে দিনভর যত জঞ্জাল জমে রাস্তার ধারে, সেসব সাফ-সুতরো করাই রিজিয়ার মতো নারীদের কাজ। এ কাজে কিছু পুরুষ কর্মীকেও নিয়োগ দিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

গভীর রাতকে আপন করে নেয়া রিজিয়ারা কেমন আছেন, রাতে কাজ করেও তারা কী করে ঘর-সংসারের চাপ সামাল দেন তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা।

রাজধানীতে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করা তিন নারী কথা বলেছেন নিউজবাংলা প্রতিবেদকের সঙ্গে। কর্মক্ষেত্র ছাড়া আরও কয়েকটি জায়গায় কাকতালীয় মিল রয়েছে তাদের।

এসব নারীর পারিবারিক জীবন দারিদ্র্যে ঘেরা। প্রত্যেকের পরিবারেই আছেন ছয়জন করে সদস্য। সবার স্বামী অসুস্থতার কারণে কাজ করতে অক্ষম। তিনজনই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি।

রাজধানীর পান্থপথে রাস্তা পরিষ্কারে ব্যস্ত সিটি করপোরেশনের নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী নাজমা ও হালিমা। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

৪৫ বছর বয়সী রিজিয়া বেগমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। স্বামী-সন্তানসহ থাকেন রাজধানীর হাজারীবাগের একটি বাসায়।

সংকটের মাঝেও দৃশ্যত নিরুত্তাপ রিজিয়া। প্রচলিত গোছালো জীবন হারিয়েছেন ২২ বছর আগেই।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ শুরুর পর রিজিয়ার দিন শুরু হয় রাত ৩টায়। বাসায় ফিরতে ফিরতে বেলা ১২টা। সপ্তাহের সাত দিন একই রুটিন।

স্বামী-সন্তান যখন গভীর ঘুমে রিজিয়া তখন সিটি করপোরেশনের এপ্রোন গায়ে জড়িয়ে বের হয়ে যান রাস্তা ঝাড়ু দিতে।

তার কর্ম এলাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মোহাম্মদপুর অংশে।

ছয় সদস্যের পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম রিজিয়া বেগম। রাত হলেই শুরু হয় শহর পরিষ্কারের কাজ। ছবি: নিউজবাংলা

৩ মার্চ ভোররাতে মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় নির্জন সড়কে ঝাড়ু দিতে দেখা যায় রিজিয়াকে।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছেন। জিজ্ঞেসা করতেই জানালেন, একটি রিকশা দরকার। আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। তাই রিকশায় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে যাওয়া দরকার। সেখানে ঝাড়ু দিয়ে বাসায় ফিরে যাবেন।

অন্যদিন দুপুরে বাসায় ফিরলেও আজ কেন তাড়াহুড়া- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পোলার বাপরে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। প্যারালাইসিস হইছে। মাঝে মাঝে ডাক্তার আর হাসপাতালে আমারেই দৌড়াইতে হয়। সারা দিন কাজের আর শেষ নাই।’

কথা শেষ করতেই একটি রিকশা পেয়ে যান রিজিয়া। রওনা দেন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের দিকে। নিউজবাংলা প্রতিবেদকও তার সঙ্গী হন।

ভোররাত তখন পৌনে ৪টার মতো। একটি দোকানের নিচ থেকে লম্বা বাটওয়ালা ঝাড়ু বের করে রাস্তা পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন রিজিয়া।

রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় সড়ক পরিষ্কারে ব্যস্ত নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী নাজমা খাতুন। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

একটুও বিরাম নেয়ার ফুরসত নেই। সূর্য ওঠার আগেই ৪০০ মিটার রাস্তার পুরোটাই পরিষ্কার করতে হবে।

এর মধ্যেই কথা চলতে থাকে রিজিয়ার সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২২ বছর ধরে এই রাস্তা ঝাড়ু দেই। একটা দিনও বাদ যায় নাই। কারণ একদিন ঝাড়ু না দিলে রাস্তায় কেউ চলতে পারব না।’

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘অনেকের ছুটি আছে, আমাগোর সেটাও নাই। আমরা না করলে এই কাজ আর কে করব। তখন শহর আর শহর থাকব না। এ জন্য আমরা ছুটি কাটাইতে পারি না। বিবেকে বাধা দেয়।’

ধূলিধূসর রাস্তায় খানিক থেমে একবুক নিঃশ্বাস নেন রিজিয়া। আনমনে আবার বলতে থাকেন, ‘আমাগো এই কাজ দেখে অনেকে প্রশংসা করে। আবার দোয়াও করে। বলে তোমরা যে কাজ করো এর জন্য আল্লাহ তোমাগো মরণের পর ভালো জায়গা দিব। এই কথা শুনলে আর কোনো কষ্ট থাকে না। শরীরটা ভালো থাকলে কষ্ট হয় না। শরীর খারাপ করলে একটু কষ্ট হয়ে যায়।’

শরীরের দিকে তাকানোর সত্যিই কোনো সময় নেই রিজিয়ার। তিনি কাজ বন্ধ রাখলে অভুক্ত থাকবে আরও পাঁচটি প্রাণ। স্বামীর চিকিৎসা হবে না। তাই ক্লান্তিতেও থামতে পারেন না এই নারী।

রিজিয়া বেগমের মতো আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী ফাতেমা বেগমের জীবনের গল্পটাও একই রকম। ছবি: নিউজবাংলা

মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। কাজে বিরতি দিয়ে রাস্তার পাশেই নামাজ পড়েন রিজিয়া। এরপর আবার রাস্তা ঝাড়ু দেয়া শুরু। একটানা কাজ চলে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।

এরপর আরও দুই ঘণ্টা কেটে যায় ঝাড়ু দেয়া সব জঞ্জাল এক জায়গায় করতে। সকাল ৯টার দিকে হাত থেকে নামে ঝাড়ু। সিটি করপোরেশনের স্থানীয় কার্যালয়ে হাজিরা খাতায় নাম তোলেন রিজিয়া। এরপর সেখান থেকে বাসায় ফিরতে সকাল সাড়ে ১০টা বেজে যায়।

ফেরার পথে রিজিয়া বলেন, ‘দেখলেন তো মামা আমাগো সময় কীভাবে কাটে। পোলার বাপরে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া লাগবে। সে জন্য আজ এক মিনিট জিরানোর টাইম পাইলাম না। সামনে গরমের সময় আসছে। তখন মাঝে মাঝে পরানডা যায় যায় করে।’

অবিন্যস্ত জীবনের মাঝেও পরিবারের সব দায়িত্ব সামলান এই নারী। রিজিয়া বলেন, ‘পোলা মাইয়ারা যখন ল্যাদা ছিল, তখন কামের কষ্টের চেয়ে মনের কষ্ট বেশি হইত। ঢাকা শহরে আমাগো কোনো আত্মীয় নাই। তয় ওগো বাপ তখন সুস্থ ছিল, রিকশা চালাইত। মাইয়ারে বাপের কাছে ঘুমায়ে দিয়ে কাজে আসতাম। এখন রাত ৩টায় আসি। তখন আসতাম ১টার দিকে। কারণ আমার স্বামী সকাল হইলেই রিকশা নিয়ে বাইর হইয়া যাইত।

‘বাচ্চাগো রেখে সারা রাত বাইরে থাকতে হইত বলে সারা দিন ওগো কোল থেকে নামাইতে মন চাইত না। খুব ঘুম ধরত, তার মধ্যেই সংসারের কাম করতাম।’

এবার বিষণ্নতা চেপে ধরে রিজিয়াকে। ধরা গলায় বলেন, ‘আমার সবচেয়ে কঠিন সময় গেছে যখন চারটা বাচ্চাই পৃথিবীতে আসছে। যখন ওগো বাপ কাজ করতে পারে না। বাচ্চাগো তার কাছে দিয়ে কাজে যাইতে ভরসা লাগে না। কারণ সে-ও তো অসুস্থ। আয়ও কমে গেছে তখন। একার আয়ে সংসার চলে না। সে সময় বেতন কম। কী করি, কী করি করে বেড়াই।’

রিজিয়া, ফাতেমা, পারভীনদের মতো রাত হলেই কাজে নেমে পড়েন নাজমা খাতুন, তার জীবনটাও সংগ্রামী। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস

আগের কয়েক ঘণ্টা ভাবলেশহীন রিজিয়ার চোখ এবার ভিজে এসেছে। প্রায় দুই দশক আগের কঠিন সময়ের বর্ণনা করে বলেন, ‘সকালে বাসায় ফিরে বাচ্চাদের পরিষ্কার করে গুছিয়ে তারপর সংসারের কাজে হাত দিতাম। রান্না করতাম। তারপর সবাইকে খাইয়ে ছোট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে একটা বাসায় ঝাড়ামোছার কাজ করতাম, যাতে একটু বেশি আয় হয়।

‘এরপর বাসায় ফিরে নিজের গোসল-খাওয়া শেষ করে বাচ্চাগুলোকে কোলের মধ্যে নিয়ে চোখ বুজতাম। দুই-এক ঘণ্টা ঘুমিয়ে আবার বিকেলের কাজ শেষ করে রান্না করতে করতে রাত। এরপর বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আবার কাজ।’

তবে এখন কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে রিজিয়ার। সব মিলিয়ে বেতন মানে ২১ হাজার টাকা। সন্তানরাও বড় হয়েছে।

রিজিয়া বলেন, ‘এখন সন্তানরা বড় হইছে। লেখাপড়া করছে। শত কষ্টের পরেও তাদের লেখাপড়া করাইছি। তয় এখনও কেউ চাকরি জোগাড় করতে পারেনি।

‘এখনও সব কাজ আমারই করা লাগে। এই যে এখন কাজ শেষ করে ফিরে রান্না করা লাগবে, তারপর সবাই খাবে। আমি অন্য সব কাজ শেষ করে গোসল করে খেয়ে দুই-এক ঘণ্টা ঘুমাব। তারপর বিকেলে বাজার সদাই করা, অন্য বাসার কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে যাবে। এরপর নামাজ কালাম পড়ে একটু চোখ বোজার পরেই আবার কাজে দৌড়।’

ঘুমন্ত রাজধানীর পথে পথে আরও অনেক ‘রিজিয়া’

রিজিয়ার মতো একই ধরনের জীবনসংগ্রাম ফাতেমা বেগমের। থাকেন রাজধানীর হাজারীবাগের একটি বাসায়।

বাসা বলতে একটি মাত্র কক্ষ। ফ্লোরে বালিশ, কাঁথা আর বাসনকোসন ছাড়া তেমন কোনো আসবাব নেই।

ফাতেমার কথায়, আত্মীয়স্বজন এলে কাপড়ের আড়াল তৈরি করে শোয়ার জন্য দুটি জায়গা করা হয়। একদিকে থাকেন ছেলেরা, অন্যদিকে ঘুমান পরিবারের মেয়েরা।

উত্তর ঢাকার এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজ কষ্ট করতে পারছি বলেই সবাই মিলে পেট ভরে ভাত খেতে পারছি। নিজেকে মহিলা মনে কইরা ঘরে বইসা থাকলে সন্তানগো পড়ালেখা করাইব কে?’

৪৭ বছর বয়সী ফাতেমা বলেন, ‘ওগো বাবা সুস্থ থাকলে তো সে-ই সব করত। এখন সে পারতাছে না বইলাই তার বদলে আমি করতেছি। কাজ-কাম দায়িত্ব পালন একজন করলেই হইল। মেয়ে হইছি বইলা কি দায়িত্ব পালন করতে পারব না?’

১৬ বছর ধরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করছেন ফাতেমা। নিজের কাজ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই, বরং গর্ব ঝরে তার কণ্ঠ।

দক্ষিণ ঢাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মী পারভীন বেগম। তিনিও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন পরিবারের ভরণপোষণের পুরো দায়িত্ব।

পারভীন বলেন, ‘দিন শেষে আমরা সবাই মানুষ, মনডাই আসল। কি নারী, কি পুরুষ। আজকে আমার স্বামী সুস্থ থাকলে আমার হয়তো কষ্ট কম হইত। সে আমারে খুব ভালো পায়।’

শহরের জঞ্জাল টেনে অভাব-অনটনে থাকলেও পরিবারের সবার সঙ্গে হাসিখুশিতেই থাকতে চান পারভীন। ছবি: নিউজবাংলা

পরিবারের সান্নিধ্য খুব একটা পান না পারভীন। তা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও অন্যরকমের একটা ভালোলাগাও আছে মনের ভেতর।

পারভীন বলেন, ‘কাম-কাজের চাপেই তো আমি পরিবারে সব সময় থাকতে পারি না। সংসার চালানোর জন্য, সবাইকে ভালো রাখার জন্য আমাকে দৌড়াইতে হয়। তবে সবার জন্য নিজে কিছু করতে পারলে সেটাই তো সবচেয়ে শান্তি।’

এই নারীদের সবাই বলছেন আগের চেয়ে বেতন কাঠামো ভালো হওয়ায় কারা কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছেন। তবে সবাই আছেন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। ফলে সবার সামনেই থাকে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া পেনশন সুবিধা না থাকায় প্রৌঢ় জীবনের নানান শঙ্কা তাড়িয়ে বেড়ায় তাদের।

এ বিভাগের আরো খবর