এক দিনে সাড়ে তিনশরও বেশি শেয়ারের দরপতন। লেনদেনের সাড়ে চার ঘণ্টায় সূচকের টানা পতন, লেনদেন নেমে তলানিতে। পুঁজিবাজারের টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীরা ক্ষুব্ধ, আতঙ্কিত।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকে দেশের পুঁজিবাজারে দেখা দেয়া ধসে ব্যাপকহারে ক্ষতির মুখে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। ভালো-মন্দ নির্বিশেষে পড়ছে শেয়ারের দর। সূচক এক বছর আগের কাছাকাছি নেমে এসেছে।
এই টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ২০১০ সালের মহাধসের স্মৃতি যে ফিরেছে, সেটি পুঁজিবাজারকেন্দ্রিক নানা ফেসবুক পেজে ঢুঁ দিলেই বোঝা যায়।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ হামলা শুরুর দিন সূচক যত পড়েছিল, অষ্টম কর্মদিবসে সোমবার তা পড়েছে আরও বেশি। এই কয় দিনে সূচক পড়েছে ৩৮২ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
হামলার দিন সূচক পড়েছিল ১০৯ পয়েন্ট। সেদিন সারা বিশ্বেই পতন হয়েছিল পুঁজিবাজারের, তবে পরের কর্মদিবসেই বিশ্বের প্রধান পুঁজিবাজারগুলো ঘুরে দাঁড়ালেও তার পরের কর্মদিবস ২৭ ফেব্রুয়ারি আরও বড় পতন দেখে দেশের পুঁজিবাজার। সেদিন সূচক পড়ে ১৬৩ পয়েন্ট।
চলতি সপ্তাহের প্রথম দিন ৫৭ পয়েন্ট সূচক পতনের স্মৃতি নিয়ে দ্বিতীয় কর্মদিবসে সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুর পর সময় যত গড়িয়েছে, সূচক কেবল পড়েছেই। বেলা শেষে আগের দিনের চেয়ে ১৮২ পয়েন্ট কমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৫৬ পয়েন্ট।
যে ৩৭৯ কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়েছে, তার মধ্যে দাম বেড়েছে কেবল ১০টির। এর মধ্যে আবার তিনটির দাম বেড়েছে এক শতাংশের কম। দর ধরে রাখতে পেরেছে ৮টি কোম্পানি, আর কমেছে ৩৬৪টির দর।
এক দিনে এত বেশি কোম্পানির শেয়ারের দরপতন সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি।
পুঁজিবাজারের এই অবস্থান গত বছরের ২৯ জুলাইয়ের পর সর্বনিম্ন। সেদিন ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৪২৫ পয়েন্ট। তবে সে সময় বিনিয়োগকারীরা ছিল উৎফুল্ল। কারণ, তখন বাজারে ছিল চাঙাভাব আর প্রায় প্রতি দিনই সূচক আগের অবস্থানকে ছাড়িয়ে ২০১০ সালের মহাধসের পর সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে যায়।
সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেনের চিত্র
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই পুঁজিবাজারে শুরু হয় দর সংশোধন। চলতি বছরের শুরুতে সংশোধন কাটিয়ে চাঙাভাবে ফেরার আভাস দেখা যায়। তবে সেটি স্থায়ী হয়নি। জানুয়ারির শেষেই আবার পড়তে থাকে বাজার।
এর মধ্যে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে নেগেটিভ ইক্যুইটির বিও হিসাব ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সমন্বয়ের আদেশের একটি গুজব ছড়ায়। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানায়, তারা এমন কোনো আদেশ দেয়নি। শেষে একটি আদেশ জারি হয়, তাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের কথা জানানো হয়।
এর মধ্যে বিএসইসির কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, গুজব ছড়িয়ে বাজারে পতন ঘটানো হয়েছে। যারা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের বিচার করা হবে। তবে ঘোষণাই সার, বাজারে আস্থা ফিরবে এমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
সংশোধন কাটিয়ে চলতি বছরের শুরুতে লেনদেন আবার দুই হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি চলে এলেও বাজারে ধস পরিস্থিতিতে তা অনেকটাই কমে গেছে। টানা ৭ কর্মদিবস এক হাজার কোটি টাকার কম শেয়ার হাতবদল হলো।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ডিএসই পরিচালক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি শাকিল রিজভী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বাজারে। আরও কমতে পারে-এই ভয়ে সবাই শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাইছে। সেই বিক্রির চাপে বাজারে বড় পতন হচ্ছে।
‘ছোট-বড় সব বিনিয়োগকারীই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। বুঝতে পারছি না যুদ্ধের ডামাডোলে বাজার শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে নামবে।’
বিক্রির চাপ কমাতে লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি না করতে বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দিয়েছেন শাকিল রিজভী। বলেছেন, বিক্রয়চাপ কমলেই ধীরে ধীরে আতঙ্ক কাটবে।
আরেক বাজার বিশ্লেষক ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাক আহমেদ সাদেক বলেন, ‘যুদ্ধের প্রভাব বাজারে পড়েছে ঠিক। কিন্তু এর বাইরে কোনো কারসাজি করে বাজার অস্থিতিশীল করা হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে বিএসইসিকে। যদি অন্য কোনো কারণে বাজারে অব্যাহত পতন হয়, তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা দিতে হবে।’
‘আমাদের দুর্ভাগ্য ৫০ বছরের বাংলাদেশেও একটি সুস্থির পুঁজিবাজার পেলাম না’-বলেন এই বাজার বিশ্লেষক।
সবচেয়ে বেশি দরপতন যেসব কোম্পানির
যেসব কোম্পানির দরপতন হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১০ শতাংশ পতন হয়েছে লোকসানি কোম্পানি মেঘনা কনডেন্সড মিল্কের।
৯ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে আরও তিনটি কোম্পানির। এগুলো হলো আরামিট সিমেন্ট, ভ্যানগার্ড এএমএল রূপালী ব্যাংক ব্যালান্সড ফান্ড ও এপেক্স স্পিনিং মিলস।
৮ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে আরও চারটি কোম্পানির। এগুলো হলো: জুট স্পিনার্স, সাভার রিফ্রাকটরিজ, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স ও এনভয় টেক্সটাইল।
৭ শতাংশের বেশি দরপতন হয়েছে আরও ৭টি কোম্পানির। এগুলো হলো: হাওয়েল টেক্সটাইল, এএফসি এগ্রোবায়োটেক, মিথুন নিটিং, রূপালী ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেনসন, পেনিনসুলা ও ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স।
আরও ২৪টির দর ৬ শতাংশের বেশি, ৪৭টির দর ৫ শতাংশের বেশি, ৬৭টির দর ৪ শতাংশের বেশি কমেছে।
সূচক পতনে বেশি ভূমিকা যেসব কোম্পানির
টানা দ্বিতীয় দিন সূচক পতনে প্রধান ভূমিকায় ছিল বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো।
শেয়ারদর ৩.০৩ শতাংশ কমার কারণে সূচক পড়েছে ১৭.২২ পয়েন্ট। গ্রামীণফোনের দর ১.৭ শতাংশ কমায় সূচক পড়েছে ১৩.২৩ পয়েন্ট।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা লাফার্জ হোলসিম সিমেন্টের দর ৬.৬৩ শতাংশ কমায় সূচক পড়েছে ৯.১ পয়েন্ট।
ওয়ালটন, বেক্সিমকো লিমিটেড, স্কয়ারফার্মা, বেক্মিমকো ফার্মা, রেনাটা, বার্জার পেইন্টস ও ইউনাইটেড পাওয়ারও সূচক পতনে প্রধান ভূমিকায় ছিল।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানির কারণে সূচক পড়েছে ৭৭.৮২ পয়েন্ট।