ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার জয়নাল আবেদীন ৯ বছর ধরে নিখোঁজ। তাকে অপহরণ করে হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছিল। বিচারক সেই মামলার রায়ে বৃহস্পতিবার ছয় আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছেন। আর সন্তানহারা বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছেরাজুল হক পথ পথে ঘুরছেন বিচারের আশায়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত জানায়,তদন্তে পুলিশের অবহেলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন। এ জন্য পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) স্বপন চন্দ্র বড়ুয়া এবং এসআই মো. আমির হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
মামলার বাদী ছেরাজুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে শুনে খুশি হয়েছি। কিন্তু সন্তান হারানোর বিচারের জন্য এখন তাহলে কার কাছে যাব? অপহরণ-হত্যা যদি না হয়, তাহলে আমার ছেলেকে ফেরত চাই। আর হত্যা হলে বিচার চাই।’
ফেনীর জেলা ও দায়রা জজ ড. বেগম জেবুন নেছা গত বৃহস্পতিবার ছয় আসামির সবাইকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেন।
রায় ঘোষণার সময় আদালতে পাঁচ আসামি উপস্থিত ছিলেন। একজন পলাতক। আসামিরা হলেন, নাছির উদ্দিন লিটন, ইসমাইল হোসেন দুলাল, সিরাজুল ইসলাম মাস্টার, দুলাল হোসেন খোকন, নাজমুল হন নয়ন ও নুর করিম।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক জয়নাল আবেদীন ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বাড়ির পাশের চা দোকান থেকে নিখোঁজ হন। ১২ জানুয়ারি তার গায়ের জ্যাকেট পাওয়া যায় বড় ফেনী নদীর তীরে।
এ ঘটনায় জয়নালের বাবা ছেরাজুল হক ১৮ জানুয়ারি চারজনকে আসামি করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আমির ছয়জনকে অভিযুক্ত করে ২০১৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন। একই বছরের ২৪ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করে আদালত। বিচার শেষে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আসামিরা জয়নালকে অপহরণের পর ফেনী নদীর ধারে নিয়ে হত্যা করে এবং বালুচরে পুঁতে রাখে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ আদালতে দিতে পারেনি পুলিশ। ভিকটিমের গায়ের জ্যাকেট কত তারিখে, কোন সময়ে, ফেনী নদীর ঠিক কোন স্থান থেকে উদ্ধার হয়েছে সেটিও উল্লেখ করা হয়নি। নিখোঁজের জিডিতে ভিকটিমের যে মোবাইল নম্বর উল্লেখ করা হয়েছিল, তা খুঁজতে চেষ্টা করেনি পুলিশ। নিখোঁজের আগে ও পরে মোবাইল ফোনটির অবস্থান যাচাইয়ের প্রমাণ আদালত পায়নি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করে আদালত বলেছে, ‘মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্ত ভুল পথে নিয়ে গেছেন। তারা নিখোঁজ বা হত্যার অভিযোগের ‘প্রকৃত তদন্ত’ করেননি। ভিকটিম জীবিত নাকি মৃত, তা যাচাইয়ে পুলিশ তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেনি। নিখোঁজের পর আজও ভিকটিমকে না পাওয়ার বিষয়ে সুষ্ঠু ও বিস্তারিত তদন্ত না করার দায় সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে অবশ্যই নিতে হবে।
‘তা না হলে ভবিষ্যতে এ দেশে দুষ্কৃতিকারী ও নৃশংস খুনিরা আইন নির্ধারিত শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যাবে এবং এ দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রসারিত হবে। শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে।’
এ পরিস্থিতি নিয়ে আইনজীবী শাহজাহান শাজু বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে আদালত যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা সঠিক। পুলিশ চাইলে প্রকৃত অপরাধী চিহ্নিত করতে পারত। এ রকম বহু মামলা পুলিশের গাফিলতিতে শেষ হয়ে যায়। বিশেষ উদ্দেশ্যে পুলিশ সঠিক তদন্ত করে না।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হাফেজ আহম্মদ বলেন, ‘সব আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়ার রায়ে আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব। জয়নালকে অপহরণ করে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে। ঘটনার পাঁচ দিন পর তার জ্যাকেট উদ্ধারে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আসামিদের সঙ্গে জয়নালদের জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধের মামলা ছিল।’
জয়নাল হত্যা মামলার আসামিদের বৃহস্পতিবার ফেনী জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির করা হয়। ছবি: নিউজবাংলা
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ হানিফ মজুমদার বলেন, ‘জয়নাল আত্মগোপনও করতে পারে। হত্যা মামলা হলেও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নেই। সম্পত্তির বিরোধ নিয়ে অনুমাননির্ভর আসামি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের দোষী প্রমাণ করতে পারেনি। তাই মামলায় আসামিরা খালাস পেয়েছেন।’
জয়নালের ভাই নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘পুলিশ তদন্ত না করার কারণে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। যারা খালাস পেয়েছে তারা নির্দোষ, তাহলে অপরাধী কে? পুলিশ অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারত, সেটা করেনি।
আরেক ভাই আলাউদ্দীন বলেন, ‘আমরা এই মামলার পুনঃতদন্ত চাই। যাদের অভিযুক্ত করেছিলাম আদালত থেকে তারা খালাস পেয়েছেন; তাহলে যারা অপরাধী তাদের চিহ্নিত করা হোক। আমরা চাই অপরাধী আইনের আওতায় আসুক। আমার ভাইয়ের নিখোঁজের রহস্যের উন্মোচন হোক।’
মামলার রায় প্রসঙ্গে আইনজীবী ফয়জুল হক মিল্কী বলেন, ‘পুলিশের তদন্তে দুর্বলতা ছিল। আদালতে দেয়া অভিযোগপত্রে তাদের ব্যর্থতা ছিল। যে অটোরিকশায় এসে জয়নালকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই গাড়িটির খোঁজ করা দরকার ছিল। মামলার তদন্তে সেলুনকর্মীর নাম এলেও সাক্ষী হিসেবে তাকে রাখা হয়নি।’
পুনঃতদন্ত বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়ার সময় বাদীপক্ষ এবং পাবলিক প্রসিকিউটর নারাজি দিতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে তা দেয়া দরকার ছিল। তখন আপত্তি জানালে মামলাটি পুনঃতদন্তে যেতে পারত। নিম্ন আদালতে মামলাটি চলমান অবস্থায় বিচারক চাইলে পুনঃতদন্ত দিতে পারতেন। মামলার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে সেটা আর সম্ভব নয়। এখন মামলার বাদী যদি উচ্চ আদালতে আপিল করেন, তখন পুনঃতদন্তের সুযোগ মিলতে পারে।’