সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে লোলা গাঙ। কুশিয়ারা নদী থেকে শুরু হয়ে সোনাই নদীতে মিশেছে ছোট্ট এই নদী। তবে দখল আর দূষণে লোলা নদী পরিণত হয়েছে মরা খালে। অনেক জায়গায় পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে নদী। পানির চিহ্ন নেই।
মৃতপ্রায় নদীকে আরও সংকটে ফেলেছে বিয়ানীবাজার পৌরসভা। বিয়ানীবাজারের লাসাইতলা এলাকায় লোলা গাঙ থেকে একটি খাল প্রবাহিত হয়েছিল উপজেলার দুটি ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে। বাবুর খাল নামক এ খালটি লোলা গাঙের পানির অন্যতম উৎস। আশপাশের গ্রামগুলোরও পানির উৎস ছিল এই খাল। তবে এটির উৎসমুখ ভরাট করে বিয়ানীবাজার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ সেখানে বাস টার্মিনাল নির্মাণ করছে।
বিয়ানীবাজারের মাথিউড়া ও তিলপাড়া ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, খাল ভরাট করায় বর্ষা মৌসুমে এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। শুষ্ক মৌসুমে কৃষিকাজের জন্যও পানি পাওয়া যায় না। ফলে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে অনেক কৃষিজমি।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, খাল নিশ্চিহ্ন করার মাধ্যমে সংকটে থাকা লোলা গাঙকে পঙ্গু করে দিয়েছে পৌরসভা। লোলা গাঙ ও বাবুর খাল খনন ও দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
তবে বিয়ানীবাজার পৌর কর্তৃপক্ষের দাবি, খালের জায়গা ছেড়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে বাস টার্মিনাল। নির্মাণকাজ শুরুর আগে স্থানীয় বাসিন্দারাই দখল করে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছেন বাবুর খাল। লোলা গাঙও দখল করে রেখেছেন নদীর দুই তীরের বাসিন্দারা। এই নদী ও খাল উদ্ধারে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পৌর মেয়র।
পানিপ্রবাহ বন্ধ করে টার্মিনাল নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে পৌরসভার বিরুদ্ধে। ছবি: নিউজবাংলা
পৌর শহরকে যানজট মুক্ত করতে ও সড়কে গাড়ি পার্কিং রোধে ২০২০ সালে লাসাইতলা এলাকায় বাস টার্মিনাল নির্মাণকাজ শুরু করে বিয়ানীবাজার পৌরসভা। টার্মিনালের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। টার্মিনালটির নির্মাণকাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বাবুর খালের উৎসমুখ সম্পূর্ণ ভরাট করে ফেলে পৌর কর্তৃপক্ষ। এ সময় পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি।
বাবুর খাল ভরাটের প্রতিবাদে গত ১ মার্চ বাস টার্মিনালের সামনে মানবন্ধন করেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা।
স্থানীয় সংগঠক আজিজুর রহমান সেলিম বলেন, লোলা গাঙ দখলের ফলে এমনতিইে পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংকটে পড়েছিল। এখন বাবুর খালের উৎসমুখ ভরাট করে ফেলায় সংকট আরও বেড়েছে।
তিনি বলেন, ‘এ খালটি মাথিউড়া ও তিলপাড়া ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এসব ইউনিয়নের কৃষকদের সেচের পানির প্রধান উৎস ছিল এই খাল। কিন্তু এখন পানির অভাবে কৃষকরা সেচের পানি পান না। আর বর্ষা মৌসুমে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।’
স্থানীয় বাসিন্দা কামাল আহমেদ বলেন, পৌর কর্তৃপক্ষ উৎসমুখ ভরাটের পর খালের তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারাও খালটি দখল করে ভরাট করে ফেলেছেন। ফলে পুরো খালের অস্তিত্বই এখন হারিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে লোলা নদীর অনেকাংশ দখল করে রেখেছে। ফলে এমনিতেই নদীটি সংকটে আছে। এ অবস্থায় নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালের উৎসমুখ পুরোটা ভরাট করে ফেলায় এই নদী এখন সম্পূর্ণ পানিহীন হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে খালের মতো নদীটির অস্তিত্বও থাকবে না। এ ছাড়া খাল ভরাটের ফলে এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীবনযাত্রাও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।’
তিনি দ্রুত বাবুর খালের উৎসমুখ থেকে স্থাপনা উচ্ছেদ ও লোলা গাঙ খনন করার দাবি জানান।
তবে বাবুর খাল অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে জানিয়ে বিয়ানীবাজার পৌরসভার মেয়র আব্দুস শুকুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিভিন্ন ভূমি জরিপে খালের উল্লেখ থাকলেও আমি মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর এখানে কোনো খালের অস্তিত্ব পাইনি। তা আগেই স্থানীয়রা ভরাট করে নিয়েছেন। আর আমরা বাসস্ট্যান্ড করেছি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে। খালের ওপরে না।’
মেয়র বলেন, ‘লোলা নদীতে আমরাও ছোটবেলায় সাঁতার কেটেছি। তখন বড় বড় নৌকা চলত। এটি পৌর এলাকার পানি নিষ্কাষণের একমাত্র জায়গা ছিল। আজকে নদীই নেই। ফলে নদীর আশপাশের এলাকায় চাষাবাদও এখন হয় না।’
মেয়র বলেন, বাবুর খালের জন্য না, স্থানীয়রা দুই তীর দখল করে নেওয়ার কারণেই লোলা নদী অস্তিত্ব সংকটে। ফলে পৌর এলাকায় জলাবদ্ধতা লেগে থাকে। নদীর সীমানা নির্ধারণ করে খননের উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে জানান মেয়র।
তবে বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ শুরুর আগে খালের জায়গা ছাড়ার প্রয়োজন ছিল জানিয়ে বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশিক নূর বলেন, ‘তখন আমি ছিলাম না। এইটা এভাবে করা ঠিক হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘গত সমন্বয় সভাতেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই খালের সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে। সীমানা নির্ধারণ হয়ে গেলে এলজিইডি খাল উদ্ধারে কাজ করবে। খাল ভরাটের বিষয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত করছে।’