বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পরও পাহাড়ে ও সমতলে বসবাসরত পাহাড়িরা এখনও অনেকাংশে পিছিয়ে। মূলধারার আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ৫০টিরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।
পার্বত্য অঞ্চলে চাকমারাই বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ। বর্তমানে সেখানে রাখাইন, সাঁওতাল, অহমিয়াসহ মোট ১৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস দেখা যায়। এদের রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। মূলধারা থেকে পিছিয়ে থাকার পেছনে সরকারকেই দায়ী করছেন তাদের নেতারা।
পাহাড়ি নেতাদের দাবি, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই মূলধারা থেকে পিছিয়ে পড়েছে আদিবাসীরা। কিছু এনজিও পাহাড়ে ভাষা নিয়ে কাজ করলেও তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায় না।
পাহাড়ি নেতা ইন্টু মনি তালুকদার বলেন, ‘উন্নয়নের দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা জনগোষ্ঠী শিক্ষায় একটু অগ্রসর হলেও মুরং, খুমি, লুসাই, পাংখোয়াসহ অন্য সম্প্রদায়গুলো সব দিক দিয়েই পিছিয়ে।’
এই পিছিয়ে থাকার মূল কারণ হিসেবে চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ কম দেয়াকেই দায়ী করছেন ইন্টু মনি। তিনি জানান, শিক্ষাক্ষেত্রে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এই তিন জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হলেও অন্যদের ভাষা পাঠদান ব্যবস্থা দেখা যায় না।
অন্যদিকে পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো মনোভাব দেখতে পাচ্ছেন না পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া নাগরিক অধিকার পাওয়ার জন্য যে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন আছে সেখানে ১৪টি জনগোষ্ঠীর কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই।’
নান্টুর মতে, চাকমা ছাড়াও মারমা, ত্রিপুরা, গুর্খা, অহমিয়াসহ যারা আছে তাদের ভাষাসহ অন্যান্য অধিকার এবং নিজস্ব সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য দরকার পৃষ্ঠপোষকতা। কিন্তু পার্বত্য জেলা পরিষদ, আঞ্চলিক পরিষদ, উন্নয়ন বোর্ড ও পৌরসভা থেকে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকমা ছাড়া অন্য পাহাড়ি গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্ব না থাকায় তারা পিছিয়ে গেছেন বলে দাবি করেছেন নান্টু।
রাঙ্গামাটি বিএস ইনস্টিটিউটের প্রভাষক আনন্দ জ্যোতি চাকমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি জাতিসত্তাকে মূলধারার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে যে ধাপগুলো রয়েছে, সেসব অতিক্রম করতে হবে। মূল স্রোতধারার বাংলা ভাষাভাষীদের মতো আদিবাসীরাও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অংশ। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে পশ্চাৎপদ বলে বলে পশ্চাৎপদ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে হবে। মাতৃভাষাকে কীভাবে টিকিয়ে রাখার পাশাপাশি পাহাড়িদের অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের যে ধারা রয়েছে, সেগুলো চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’
জাতি তাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমারা। কাপ্তাই বাঁধের আগে থেকেই চাকমারা এখানে স্থানীয় ছিল। এমনকি সংখ্যায়ও ছিল বেশি। শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়ায় তারা অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে কিছুটা অগ্রসর হয়েছে।
অন্যদেরও নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে, ভাষা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বহু বছর ধরে এসব বর্ণমালা, ভাষা ও সংস্কৃতি অবহেলিতই থেকে গেছে।