বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যুবলীগ নেতার অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রামবাসী

  •    
  • ৫ মার্চ, ২০২২ ১৫:৩৯

'জয়ের চাচা নূরে খাঁ পাবলিকের সঙ্গে জোরজুলুম করে। রাস্তায় যদি কেউ একটা অটো নামায়, নূরে খাঁ (জয়ের আরেক চাচা) কয়, ট্যাকা দেও। ট্যাকা না দিলে গাড়ি চালাইবার দিব না। সপ্তাহে তারে ৫০০-১০০০ ট্যাকা দিতে হইব। না দিলে মারে, অটো চালাইতে দেয় না। আমাগো এলাকার ৫০-৬০ জন অটোর চালক হ্যাগো যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। যুবলীগ নেতা জয়ের শেল্টারে সে এগুলা করে।’

ঢাকার সাভারে এক ইউনিয়ন যুবলীগ নেতার চাঁদাবাজি, মারধর ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনেছেন একটি গ্রামের বাসিন্দারা। একই অভিযোগ করেছেন খোদ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা।

অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা আমির হোসেন জয় শিমুলিয়া ইউনিয়নের সভাপতি।

সম্প্রতি কেবল ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে ওই যুবলীগ নেতা ও তার স্বজনদের সঙ্গে এক বিএনপি নেতার বিরোধ শুরু হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাইয়ের ওপর যুবলীগ নেতার নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়। রড, পাইপ, লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়ায় আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয় এলাকায়। মারধর করে আহত করা হয় সাত-আটজনকে।

পরে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী শিমুলিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আমির হোসেন জয়ের বাড়িতে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালায়। এতে ওই যুবলীগ নেতার পরিবারের সদস্যসহ ১৩ জন আহত হন।

স্থানীয়দের হামলায় যুবলীগ নেতা জয়ের পরিবারের সদস্যসহ ১৩ জন আহত হন। ছবি: নিউজবাংলা

মারামারির ঘটনার এক দিন পর ২৭ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়া থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি আব্দুল হাইকে আসামি করে মামলা করেন যুবলীগ নেতা জয়। ওই মামলায় উদ্দেশ্যেপ্রণোদিতভাবে আসামি করার অভিযোগ করেছেন শিমুলিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার জাহাঙ্গীর হোসেন।

তবে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে থাকায় মামলা করতে গেলেও তা নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছে গ্রামবাসী।

নিউজবাংলার অনুসন্ধানে যুবলীগ নেতা জয় ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ। এমন অভিযোগও আছে, এলাকায় কোনো নির্মাণ কাজ করতে হলে পণ্য কিনতে হয় তাদের দোকান থেকে।

জয়ের বিভিন্ন ধরনের অন্যায় ও অত্যাচারের কথা জানিয়েছে শিমুলিয়া ইউনিয়নের রণস্থল গ্রামের অনেক বাসিন্দা।

এলাকাবাসীর ওপর হামলা

গ্রামবাসী জানায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রণস্থল গ্রামের ১ নম্বর ওয়ার্ডের গণি মার্কেট এলাকায় ১০-১২ জন লোক নিয়ে হামলা চালান যুবলীগ সভাপতি জয়। এ সময় ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের বড় ভাই নূর হোসেনকে রড দিয়ে মারধর করা হয়।

শাহজাহান মল্লিক নামে একজনকে কুপিয়ে আহত করে একটি বাড়িতে তালাবদ্ধ করে আটকে রাখেন জয়। পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে। পরে নূর হোসেনের ভায়রা তোফাজ্জল মল্লিক, শাকিলসহ আরও সাত-আটজনকে একে একে ধরে মারধর করে জখম করে জয়ের লোকজন।

সেদিন সামনে থেকে লাঠি ও ইট হাতে নেতৃত্ব দেন জয়। মোবাইলে ধারণকৃত এমন কিছু ছবি ও ভিডিও এসেছে নিউজবাংলার হাতে।

এ ঘটনার পর পরই জয়ের বাড়িতে হামলা চালায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। এতে জয়ের মা-বাবা, স্বজনসহ ১৩ জন আহত হয়েছেন বলে দাবি জয়ের।

হোটেল ব্যবসায়ী আবু তালেব নিউজবাংলাকে বলেন, 'দুপুর বেলা দৌড় পাইরা ৮-১০ জন লোক আইসা মেম্বারের বড় ভাইরে হাতের মইদ্দে রড দিয়া তিন-চার বারি দিয়া ভাইঙা দিছে। জয় ও তার চাচা সামন খাঁসহ অনেকে মারছে। কোনো কিছু বোঝার আগেই হ্যারা মারধর শুরু করছে। রড, শাবল, লাঠি নিয়া আইছিল হ্যারা। আমরা যে থামামু এই ধরনের কোনো উপায় নাই। তখন সব দোকানদার আমরা আতঙ্ক হইয়া গেছিলাম। মেম্বার সাহেবের ভাই তো খুব ভালো লোক। জমিজমার ব্যবসা করে। কোনো দিন কারও সাথে ঝামেলাও নাই।'

তিনি বলেন, 'জয়ের চাচা সামন খাঁর ডিশ ব্যবসা আছে এই এলাকায়। কয়দিন আগে শুনছি এই ব্যবসা নিয়া ঝামেলা হইছে আব্দুল হাইয়ের সঙ্গে।’

চা দোকানি আজরত আলী বলেন, ‘আমরা সবাই ওই সোম (সময়) কাজকাম করবার নাগছি। মেম্বারের ভাই তিন রাস্তার মইদ্দেখানে খাড়া। তখন তেমন কোনো মানুষ আছিল না। হঠাৎ কইরা জয়সহ ১০-১২ জন আইসা হ্যারে হুরুম-ধারম বাড়ি শুরু করছে। পরে দোকানের পিছনের দিকে শাকিলের বাইত্তে গিয়া ওরেসহ আরও কয়েকজনরে মারছে।’

ওই দিন মেম্বার আর আমি অন্য এক জায়গায় গেছি একটা বিচারে। পরে শুনি এইখানে মারামারি শুরু কইরা দিছে। জয় ও তার চাচা সামন খাঁ তাগো ক্ষমতায় এলাকায় মানুষরে মানুষ মনে করে না।

শিমুলিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জাহাঙ্গীর আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে কে বা কারা জয়ের চাচার ডিশের লাইনের তার কাটছে। আমি কিংবা আমার পরিবারের কেউ এই ডিশ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত না। কিন্তু নির্বাচনকালীন পূর্বশত্রুতার জেরে আমার বড় ভাই ও ভাতিজাকে এসে হঠাৎ মারধর করছে তারা। আরও কয়েকজনরে মারছে। পরে আমারে মামলার দুই নম্বর আসামি করছে। আমি অভিযোগ দিতে গেছি, কিন্তু পুলিশ নেয় নাই। এখন গ্রেপ্তারের ভয়ে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

অটোরিকশায় চাঁদাবাজি

আনোয়ার হোসেন নামে এক অটোচালক বলেন, 'জয়ের চাচা নূরে খাঁ পাবলিকের সঙ্গে জোরজুলুম করে। রাস্তায় যদি কেউ একটা অটো নামায়, নূরে খাঁ (জয়ের আরেক চাচা) কয়, ট্যাকা দেও। ট্যাকা না দিলে গাড়ি চালাইবার দিব না। সপ্তাহে তারে ৫০০-১০০০ ট্যাকা দিতে হইবে। না দিলে মারে, অটো চালাইতে দেয় না। আমাগো এলাকার ৫০-৬০ জন অটোর চালক হ্যাগো যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। যুবলীগ নেতার জয়ের শেল্টারে সে এগুলা করে।’

নিজেদের দোকান থেকে পণ্য কেনায় জোরাজুরি

শিমুলিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, 'ওই দিন মেম্বার আর আমি অন্য এক জায়গায় গেছি একটা বিচারে। পরে শুনি এইখানে মারামারি শুরু কইরা দিছে। জয় ও তার চাচা সামন খাঁ তাগো ক্ষমতায় এলাকায় মানুষরে মানুষ মনে করে না।’

পুলিশ ঠিকভাবে তদন্তও করে নাই। গ্রামের সব মহিলারাও আইছিল আসল ঘটনা কইবার। পুলিশ কারও সাক্ষী না নিয়াই চইলা গ্যাছে গা।

তিনি বলেন, ‘প্রতিবার জাতীয় নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে নির্বাচন কমিটির প্রধান ছিলাম আমি। তাগো দুইটা রড, সিমেন্টের দোকান। যেই বাড়িঘর করুক ওই দোকান থাইকা সব কিনতে হইব। আমার নিজের বাড়িতে একটা ঘর তুলতে গিয়াই তাগো বাধার মুখে পড়ছি। আমি টিন আনমু অন্যহান থনে (অন্য দোকান থেকে)। কিন্তু আমারে আনতে দেয় নাই। আমারে তো মারতে পারে নাই। তবে এলাকার কোনো মিস্ত্রিরে কাম করবার দেয় না, কাম বন্ধ কইরা দেয়।’

এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিতে মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে বললেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। বলেন, ‘তারা চায় রাজ্যটা জিম্মি কইরা রাখতে।’

এই আওয়ামী লীগ নেতার অভিযোগ, হামলার সেই ঘটনা নিয়ে পুলিশ যে তদন্ত করেছে, সেটি নিরপেক্ষ হয়নি। তিনি বলেন, ‘পুলিশ ঠিকভাবে তদন্তও করে নাই। গ্রামের সব মহিলারাও আইছিল আসল ঘটনা কইবার। পুলিশ কারও সাক্ষী না নিয়াই চইলা গ্যাছে গা।'

এই গ্রুপটা পুরাই সন্ত্রাসী: চেয়ারম্যান

শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ বি এম আজহারুল ইসলাম সুরুজ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে খালি ডিশ ব্যবসা নিয়া ঝগড়া না খালি, বহুত কিছু। ওই গ্রুপটা (জয়ের গ্রুপ) পুরা সন্ত্রাসী। অরা আওয়ামী লীগও না, বিএনপিও না। অগোর কোনো ধর্মকর্ম নাই। এরা সব লাঠি দল করে।’

ওর সঙ্গে তো আমার ব্যবসায়িক শত্রুতা ও রাজনৈতিক শত্রুতা নাই। তাহলে ও (মেম্বার) আসল ক্যান? আমার পুড়ান বাড়ি হলো গণি মার্কেট এলাকায়। কিন্তু ওখানে আমি থাকি না। আমার আত্মীয়স্বজন থাকে।

জয় যা বলছেন

সেই দিনের হামলার বিষয়ে যুবলীগ নেতা আমির হোসেন জয় নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বাড়িতে ওরা হামলা করছে। মেম্বার জাহাঙ্গীর ওই সময় এখানেই ছিল। আমার কাছে ভিডিও ফুটেজ আছে।

‘ওর সঙ্গে তো আমার ব্যবসায়িক শত্রুতা ও রাজনৈতিক শত্রুতা নাই। তাহলে ও (মেম্বার) আসল ক্যান? আমার পুড়ান বাড়ি হলো গণি মার্কেট এলাকায়। কিন্তু ওখানে আমি থাকি না। আমার আত্মীয়স্বজন থাকে।’

আপনি গণি মার্কেট এলাকায় হামলা চালিয়ে মারধর করেছেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমাকে হেয় করার কারণ হলো, আমি যাতে আইনের কাছে যেতে না পারি।’

তবে অটোরিকশায় চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই ফোন রেখে দেন তিনি।

তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য

মারামারির মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) আব্দুর রাশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মারামারির ঘটনায় ২৭ ফেব্রুয়ারি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে ১৪ জনকে। আমির হোসেন জয় মামলার বাদী।’

যুবলীগ নেতা জয় আগে হামলা চালিয়ে ইউপি সদস্য জাহাঙ্গীরের ভাইসহ কয়েকজনকে আহত করেছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কেন গ্রহণ করা হয়নি এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি তাদের অভিযোগ পাই নাই আরকি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর