শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে নারীরা মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছেন। দেশের ৬৯.৯২ শতাংশ নারী শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন। ৩৭.২৪ শতাংশ নারীকে শরীরের গঠন নিয়ে আত্মীয়রা হেয় করেছে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
গবেষণাটি করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন। শনিবার সকাল ১১টায় ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মলনে ‘নারীদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক জরিপটি প্রকাশ করা হয়।
বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হয়েছেন এমন ১ হাজার ১৪ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেন সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৬৯.৯২ শতাংশ নারী শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৭.২৪ শতাংশ নারী জানান, শরীরের গঠন নিয়ে তাদের আত্মীয়রাই হেয় করেছে।
বন্ধুর কাছে হেয় হয়েছে ২২ শতাংশ। এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪.২৫ শতাংশ। শারীরিক গঠন নিয়ে পথচারীর কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনেছেন ১১.৮৫ শতাংশ নারী।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এসেছে, ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯.৪৯ শতাংশ নারী মনে করেন। গায়ের রঙের কারণেও ৩৬.৯৫ শতাংশ নারী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এ ছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন, কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নারীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন।
মানসিক সমস্যার জন্য দায়ী পারিবারিক টানাপোড়েনজরিপ বলছে, পারিবারিক টানাপোড়েন নারীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, যা ৩১.৮৫ শতাংশ।আর্থিক অসচ্ছলতা অংশগ্রহণকারীদের ২৪.৪৬ শতাংশের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বেকারত্বের কারণে ১৪.৭৯ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হন। ১৪.৪০ শতাংশ সামাজিকভাবে হেয় হওয়ায় ও ২.৩৭ শতাংশ নারী যৌন নিপীড়নের কারণে মানসিকভাবে প্রভাবিত হন।
অমতে বিয়ে বাড়ছে২৩.৭৭ শতাংশ নারী সম্মতি ছাড়াই পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। যারা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তাদের মধ্যে ১০৯ জনের পরিবার পরে বিয়ে না হওয়ার ভয় থেকে এমন চাপের সৃষ্টি করেন বলে জানা গেছে।কম বয়সী মেয়েদের ভালো স্বামী পাওয়া যায়- এমন ধারণার কারণে ৮৬ জনের ওপর পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ আসে। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ৮৫ জনকে বিয়ের চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে।
যৌন হয়রানির শিকার ৬৫.৫৮ শতাংশ৬৫.৫৮ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জরিপে জানা গেছে। এর মধ্যে ৩৫.৪৯ শতাংশ নারী জানান, তারা বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ নারীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। আর বিভিন্ন জায়গায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ।
ভ্রমণেও অনিরাপদ নারীগণপরিবহনে ৪৫.২৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে জরিপে উঠে এসেছে। গণপরিবহন হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির শিকার হন ৮৪.১০ শতাংশ নারী। রেল বা রেলস্টেশনে ৪.৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১.৫৩ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন।
শৈশবে আত্মীয়ের মাধ্যমে যৌন নিগ্রহের শিকার ৩৫ শতাংশজরিপে অংশ নেয়াদের মধ্যে ৩৮.৮৬ শতাংশ শৈশবে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তার মধ্যে আত্মীয়-স্বজনের দ্বারা ৩৫.২৮ শতাংশ যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। শৈশবে অপরিচিতদের দ্বারা যৌন নিগ্রহের শিকার হন ২৮.১৭ শতাংশ। এ ছাড়া ১৬.৫০ শতাংশ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে এমন আচরণের শিকার হয়।
জরিপে উঠে এসেছে, শৈশবের এসব ঘটনা ২৮.৪৩ শতাংশের মনে সবার প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম দেয় ও ২৮.১৭ শতাংশের ভেতর পুরুষবিদ্বেষী মনোভাবের সৃষ্টি হয়।
অনলাইনেও বিড়ম্বনার শিকার নারীজরিপ অনুযায়ী, অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হন ৪৩.৮৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান বলে জানায়।
আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নারীদের মানসিক বিপর্যস্ততার পেছনে অনেকাংশেই দায়ী জানিয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বলেন, ‘নারীদের প্রতি সঠিক মনোভাব ধারণ করার জন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এই শিক্ষার শুরু হতে হবে শৈশব থেকে।’
নারী ক্ষমতায়নের যুগে নারীদের এমন আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘সমাজের একটি অংশ হিসেবে নারীদের যতটুকু মর্যাদা পাওয়া উচিত, সেটা আধুনিক সময়ে এসেও আমাদের সমাজে এখনও নেই।’
ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এ অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
সমাজের প্রতিটি মানুষকে নারীদের জন্য নিরাপদ জায়গা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
এ বিষয়ে সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা বলেন, ‘বাংলাদেশে ইন্টারনেট তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে আস্থার প্রতীক হলেও অশুভ প্রয়োগ ও ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার অনেক নারীর কাছে তা এক আতঙ্কের নাম।’
সমাজকে এগিয়ে নিতে সাইবার জগৎকে নারীদের জন্য নিরাপদ রাখা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারবিধি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও পারিবারিক শিক্ষা সাইবার দুনিয়াকে সুরক্ষিত রাখতে পারে বলে জানান তিনি।
নারীদের সামাজিক ও মানসিক সুরক্ষা নিশ্চিতে আঁচল ফাউন্ডেশন কিছু সুপারিশ করেছে। নারীদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিতে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য ব্যবসা। কথার কথা বলেছে তারা। গণপরিবহন ও তার স্টপেজগুলোতে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
ইভ টিজিং ও যৌন হেনস্তার মতো ঘটনাগুলোর তাৎক্ষণিক সমাধান পেতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। শৈশবকালীন যৌন হেনস্তা, বডি শেমিং থেকে রক্ষা করতে পরিবারকে সচেতন করতে হবে।