বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সব তেল বোতলে ভরলে ১০-২০ টাকার ক্রেতাদের কী হবে

  •    
  • ৫ মার্চ, ২০২২ ১০:৫৭

‘সারা দিন বাদাম বেইচ্যা পাই হাজার-বারো শ ট্যাকা। লাভ থাকে তিন থাইক্যা ৪০০। মাইয়া-পোলা লইয়া চার জনের সংসার চালাইতে অবস্থা শেষ। ডিমের হালিও ৪০। হের লাইগ্যা ভাঙা ডিম কিনি ৩০ ট্যাকা দিয়া। আমাগো মতো মানুষরা ২০০ টাকা দিয়া এক লিটার ত্যাল কিনব কেমনে?’

আজগর মিয়া বাদাম বেচেন। কর্মস্থল কারওয়ান বাজারে। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চার সদস্যের সংসারে পুষ্টিকর খাবার কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। খরচ কমাতে তিনি একটি কৌশল নিয়েছেন। ডিমের দোকানে গিয়ে খোঁজ করেন ভাঙাগুলোর। তাতে দাম কিছুটা কম পড়ে। কিন্তু সেই ডিম খাওয়া যায়।

জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, এ নিয়ে আজগরের দুশ্চিন্তার অভাব নেই। এর মধ্যে সরকারের আরেক ঘোষণা তার কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি শুনেছেন, খোলা তেল আর বিক্রি হবে না, কিনতে হবে বোতল।

বোতলজাত সয়াবিন তেল সর্বনিম্ন ৫০০ মিলিলিটারের আছে। তবে এক লিটারের কমে পাওয়া যায় কমই। আবার এক লিটারের যত দাম, এই বোতলের দাম আরও বেশি।

তেলের দাম বাড়তে বাড়তে এখন লিটারে ১৬৮ টাকা, তবে গত কয়েক দিনে এই দামে সব জায়গায় তেল মিলছে না। ১৯০ থেকে ২০০ টাকাও কিনতে হচ্ছে রান্নার উপকরণটি।

প্রশ্ন হলো ৫০০ মিলিলিটারের তেলের বোতল যদি ৯০ বা ১০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে, তাহলে আজগরের কী হবে।

নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সারা দিন বাদাম বেইচ্যা পাই হাজার-বারো শ ট্যাকা। লাভ থাকে ৩০০ থাইক্যা ৪০০। মাইয়া-পোলা লইয়া চারজনের সংসার চালাইতে অবস্থা শেষ। ডিমের হালিও ৪০। হের লাইগ্যা ভাঙা ডিম কিনি ৩০ ট্যাকা দিয়া। আমাগো মতো মানুষরা ২০০ টাকা দিয়া এক লিটার কিনব কেমনে?’

গত দুই দশকে দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুই বছরের করোনা হঠাৎ করেই ঘটিয়েছে ছন্দঃপতন। দারিদ্র্যের হার যতটা ছিল, আয় কমে যাওয়ায় করোনা তা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। অতি দারিদ্র্যের হার করোনার আগেই ছিল ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। সেটি এখন কতটা বেড়েছে, তার নেই হিসাব।

আগের হিসাবেই বলা যায়, মরজিনার মতো পরিস্থিতিতে পড়বে অন্তত এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ।

গত বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, চলতি বছরের ৩১ মের পর থেকে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি হবে না। ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে খোলা পামওয়েল বিক্রিও বন্ধ হবে। এসব তেল বোতলে বিক্রি করতে হবে।

২০ টাকার তেল কিনতে মরজিনার পাঁচ চক্কর

কারওয়ান বাজার থেকে সবজি কুড়িয়ে এনে তেজগাঁও রেললাইনের পাশেই বিক্রি করেন এক মরজিনা বেগম (ছদ্মনাম)। স্বামী নেই, মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ ৪ জনের সংসার। ১০ থেকে ২০ টাকার ছোট ছোট ভাগে সবজি বিক্রির আয় দিয়েই সংসার চলে।

তার মেয়েও সবজি বিক্রি করেন। তবে দুই দিন ধরেই নাতনির জ্বর, যে কারণে মেয়ে কদিন ধরে বাজারে আসতে পারছেন না।

দুজন মিলে যে আয় করা যেত, একা তা করা যায়নি। দুর্মূল্যের বাজারে আয় কমে যাওয়ায় যারপরনাই বিপাকে পড়া ৫০ পেরোনো মরজিনা রান্নার তেল কিনতে গিয়ে পড়লেন বিপাকে।

সকাল থেকে দুপর পর্যন্ত ছোট্ট শিশিতে করে ১০০ গ্রাম তেল কিনতে বিজয় সরণি তেজগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে দোকানে ঘুরেছেন পাঁচ দফা। কিন্তু পাননি। দোকানি তাকে বলছেন, তেল নেই, এলেই তেল দেয়া হবে।

মরজিনার মতো তেলের দোকানি আয়েশার ব্যবসার পরিধি খুবই ছোট। তিনি কারওয়ান বাজার থেকে বোতল বা ছোট কনটেইনারে করে তেল আনেন। ১০০ বা ২০০ মিলিলিটারের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন।

এই বাজারটি গরিব মানুষের বাজার হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি এই বাজারটি ব্যাপক আলোচনায় এসেছে ছোট ছোট ভাগে পণ্য বিক্রির জন্য। এখানে তেল বিক্রি হয় সর্বনিম্ন ১০০ গ্রামে, সবজি ছোট ছোট ভাগায়, একেকটির দাম ১০ থেকে ২০ টাকা, গুঁড়া মসলাও পাওয়া যায় এমন ১০ থেকে ২০ টাকায়।

স্বল্প আয়ের, বিশেষ করে বস্তিবাসী এই বাজারের নিয়মিত ক্রেতা।

আয়েশা কেন বারবার মরজিনাকে ফিরিয়েছেন? সেখানে আসলে তার হাত ছিল না। তিনি নিজেও কারওয়ান বাজারে গিয়ে খোলা তেল পাননি। পরে ৫ লিটারের একটি বোতল কিনে তা কেটে এক পুঁটলিতে ১০০ গ্রাম তুলে দিলেন মরজিনার হাতে।

যদি ৫০০ মিলি বা এক লিটার তেল কিনতে হয় একবারে, তাহলে মরজিনার কী হবে? তার তো একসঙ্গে ২০ টাকা জোগাড় করাই কঠিন।

রেলওয়ে বাজারের ক্রেতা বেসরকারি চাকরিজীবী আফজাল বলেন, ‘আমি ১০ থেকে ২০ টাকার তেল কিনি না। কিন্তু এখানে কয়েক হাজার মানুষ আছে, যারা এক ছটাক-এক পোয়া এবং ভাগে বিক্রি সবজি-মাছ কিনে নিয়ে সংসার চালায়। আমাদেরই এক লিটার তেল কিনতে তিনবার মানিব্যাগের দিকে তাকাতে হয়। তারা কী করে এক লিটার তেল কিনবে ২০০ টাকা দিয়ে?’

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘সরকার স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে হয়তো খোলা তেল বিক্রি বন্ধ করতে বলেছে। তবে সেটা কতটা কার্যকর করা যাবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ অনেক মানুষ আছে যাদের এক লিটার কেনার সামর্থ্য নেই। এদের কথা চিন্তা করে যদি বোতল ছোট করতে হয়, তাহলে তো দাম আরও বেশি পড়বে।’

২০ টাকার তেলের জন্য হাহাকার

বৃহস্পতিবার দুপরে সেই আলোচিত গরিবের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সামনে অনেক পণ্যের পুঁটলি নিয়ে বসে আছেন দোকানিরা। তবে এর মধ্যে তেলের পুঁটলি নেই।

জানতে চাইলে দোকানি তাসলিমা বেগম বলেন, ‘দুই দিন ধইরা খোলা তেল কিনতে পাই না। হের লাইগ্যা বেচাও বন্ধ রাখছি। মানুষরা আইয়া ফিইরা যাইতাছে। ভালা লাগতাছে না।

‘বোতল ভাঙলে (বোতলজাত তেল) দামও বেশি পড়ব। আবার বেচাকেনাও কম। এক বোতল আনবার টাকাও নাই।’

তিনি বলেন, ‘এখানো (এখানে) তেল বেচা অয় কেজিতে। কিন্তু বোতল তো লিটারে। হের লাইগ্যা হিসাব রাখাও কষ্টের। আগে খোলা তেল ১৫০ টাকায় লিটার আনলে কেজি পড়ত ১৮০ টাকা। এখন বোতল আনলে লিটার রিকশা ভাড়াসহ ১৯০ টাকা পড়ে। ২১০ টাকা কেজি বেচন লাগব। এক ছটাক ২০ টাকা বেচতে অয়। তাইলে তো লস।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যা বলছে

সব তেল বোতলে ভরে বিক্রি হলে আজগর মিয়া বা মরজিনারা কীভাবে তেল কিনবেন- এমন প্রশ্নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে বর্তমান সর্বনিম্ন হাফ লিটারের বোতল থেকে আরও ছোট প্যাকেট করা হবে। সরকার এক লিটারের দাম নির্ধারণ করে দিবে, সে অনুপাতে ছোট প্যাকেটগুলোর এমআরপি লেখা থাকবে। তার বেশি দামে কেউ বিক্রি করতে পারবে না।’

তার মতে, এভাবে বাজারজাত হলে ছোট বোতলগুলো গরিব মানুষ সহজেই কিনতে পারবে।’

এই কর্মকর্তা মনে করেন, তাছাড়া প্যাকেট ও এমআরপি না থাকায় এখন বোতলের চেয়ে খোলা তেল বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

তবে বোতলের আকার ছোট হলে তার দাম বেশি পড়ে- এটা নানা পণ্যের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।

তেলের ক্ষেত্রেও এটা দেখা গেছে নানা সময়। যে সময় এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ৯০ টাকা ছিল, সে সময় ৫০০ মিলিলিটারের দাম ছিল ৫০ টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি মিল্ক ভিটার এক লিটার দুধের দাম ৭৫ টাকা হলেও ৫০০ মিলিলিটার হলে দাম হয় ৪০ টাকা। ২৫০ মিলিলিটার নিলে দাম হয় ২৫ টাকা।

অর্থাৎ গরিব মানুষের জন্য ছোট বোতলের তেল আনা হলে সেগুলোর দাম আনুপাতিক হারে বেশি পড়তে পারে।

এ বিভাগের আরো খবর