কপোতাক্ষের ক্ষীণ স্রোতধারা তীরের মানুষের মনে হাহাকার হয়ে দেখা দিচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘কপোতাক্ষ নদ’ দখল আর দূষণে এখন মৃতপ্রায়।
নদটির ওপর সেতু রয়েছে ১৬টি। এর মধ্যে ১৫টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। অন্যান্য অনেক কারণের পাশাপাশি মানুষের পারাপারে নির্মিত সেতুগুলোও এতে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নীতিমালা অনুযায়ী, দেশে চার শ্রেণির জলপথ রয়েছে। কপোতাক্ষ নদ তৃতীয় শ্রেণির জলপথের আওতাভুক্ত। এই জলপথে নদ-নদীর ওপর নির্মিত সেতুর উচ্চতা হবে পানির স্তর থেকে গার্ডারের নিচ পর্যন্ত ২৫ ফুট।
কপোতাক্ষের ওপর নির্মাণ করা সেতুগুলোর উচ্চতা এর চেয়ে কম।
অপরিকল্পিত সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর, চৌগাছা, মাশিলা, কাবিলপুর, বারবাকপুর, ঝিকরগাছা উপজেলার ছুটিপুর, মিশ্রীদেয়াড়া, ঝিকরগাছা সড়ক ও ঝিকরগাছা রেল সেতু, বেজিয়াতলা, বাঁকড়া এবং মণিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা সেতু ও চাকলা সেতু।
পরিকল্পনামাফিক নির্মাণ করা হয়েছে শুধু ঝিকরগাছা উপজেলার মাগুরা সেতুটি।
শুকিয়ে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ। ছবি: সংগৃহীত
সেতুগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) সাতটি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের দুটি, সড়ক ও জনপথের (সওজ) তিনটি, বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি।
চৌগাছা সেতুর দৈর্ঘ্য ৫০ দশমিক ১৪ মিটার। এটি ২০১৬ সালে নির্মিত হয়। নদের দুই পাশে মাটি দিয়ে কিছু অংশ ভরাট করে সেতু নির্মাণ করায় নদ সংকোচিত ও পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত করছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্মাণ শুরু করা ছয় লেনের ঝিকরগাছা সড়ক সেতুটি ১২০ মিটার দীর্ঘ। তবে সেতুটির উচ্চতা পানির স্তর থেকে গার্ডারের নিচ পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৯ ফুট। ফলে ডিঙ্গি নৌকা চলাচলও বন্ধ হয়ে যেতে বসেছে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক সাইবুর রহমান মোল্যা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ব্রিজগুলো নদকে মেরে ফেলছে। পানি প্রবাহের অভাবে নদটি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।’
চৌগাছা উপজেলার কংসারীপুর গ্রামের একুব্বার আলী সরদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একসময় কলকাতা থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভিড়ত চৌগাছায়। এখান থেকে খেজুরের গুড় বোঝাই করে জাহাজগুলো আমরা কলকাতা বন্দরের উদ্দেশে রওনা দিতাম। ২০ থেকে ২৫ বছর আগেও নদ দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা এবং পালতোলা নৌকা চলত। নিচু করে সেতু নির্মাণের পর নদ দিয়ে নৌকা চলাচল করতে পারে না।’
মণিরামপুর উপজেলার পাঁচপোতা গ্রামের আব্দুল বারিক বলেন, ‘চৌগাছা উপজেলার কাবিলপুর থেকে নৌকায় মালামাল নিয়ে নদ দিয়ে খুলনার পাইকগাছায় যেতাম। ১৯৯০ সালে শেষবার গেছি। এরপর নিচু করে নদের সেতু তৈরি করা হয়। ওই সব সেতুর নিচ দিয়ে নৌকা যায় না। এ জন্য নৌকা চালানো বাদ দিয়েছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তাওহীদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদের প্রস্থ ৭০ মিটার থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত আছে। তবে সেতুর উচ্চতার বিষয়টি দেখে বিআইডব্লিউটিএ।’
খননে ব্যয় শত শত কোটি টাকা
সেতুগুলোর এই সমস্যাটি বিবেচনায় না নিয়ে নদে প্রাণ ফেরাতে দ্বিতীয় পর্যায়ের নদী খনন কাজ চলছে। কিন্তু এই খননের সুফল মিলবে কি না, তা নিয়ে আছে সংশয়।
২০১১ সালে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পে (প্রথম পর্যায়)’ ২৮৬ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় পাখিমারার বিলে জোয়ারাধার (টিআরএম -টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) বাস্তবায়ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে কিছুটা প্রাণ ফিরে পায় কপোতাক্ষ। এরপর ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়)’ প্রকল্পটি ২০২০ সালে শুরু হয়। সেটি ২০২৪ সালে শেষ হওয়ার কথা।
সেতুগুলো আগেই নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোতে কিছুই করার নেই। এখন থেকে যে সেতুগুলো নির্মাণ করা হবে সেগুলো বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নিয়েই করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ছয়টি এলাকা। এর মধ্যে চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে মণিরামপুর উপজেলার চাকলা সেতু পর্যন্ত ৭৯ কিলোমিটার কপোতাক্ষ, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার শালিখা থেকে আমাদি পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার শালিখা শাখা নদী, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা হয়ে যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার আপার ভৈরব নদ, কপোতাক্ষ নদের সিএস ম্যাপ অনুযায়ী ২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার মাগুরা বাজার থেকে জেঠুয়া বাজার পর্যন্ত কপোতাক্ষের ২৭ দশমিক ৩০ কিলোমিটার ড্রেজিং এবং ৩২টি সংযোগ খালের ১০৮ দশমিক ৩০ কিলোমিটার পুনঃখনন করা হবে।
কপোতাক্ষ নদ পুনঃখননে এক পাড় থেকে অপর পাড়ের দূরত্ব হবে ৫৫ থেকে ৭০ মিটার।
যশোরের কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা ইকবাল কবীর জাহিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নীতিমালা লঙ্ঘন করে কপোতাক্ষের ওপর নিচু সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। সেতুর নিচ দিয়ে নদে কোনো নৌযান চলাচল করতে পারে না। অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ কপোতাক্ষ ভরাটের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করেছে। সেগুলোর সমাধান না হলে খনন করে কী হবে?’
এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আনিসুজ্জামান বলেন, ‘সেতুগুলো আগেই নির্মাণ করা হয়েছে। সেগুলোতে কিছুই করার নেই। এখন থেকে যে সেতুগুলো নির্মাণ করা হবে, সেগুলো বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নিয়েই করা হবে।’