সব বরই যখন শেষ হয়ে যাবে তখনই বাজারে আসবে টক-মিষ্টি স্বাদের ছোট বীজ আর মাংসল এক নতুন বরই। দীর্ঘ পাঁচ বছরের গবেষণায় এই বরইয়ের জাত উদ্ভাবন করেছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)।
গবেষকদের দাবি, সুস্বাদু এই বরই সবাইকে আকৃষ্ট করবে। আর যারা এটি বাণিজ্যিকভাবে চাষ করবে তারাই হবে সবচেয়ে বেশি লাভবান।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা নতুন এই জাতটির নাম দিয়েছেন বিনাবরই-১। জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন পেলেই এটির বাণিজ্যিক চাষ শুরু হবে।
সুমিষ্ট স্বাদের এই জাতটি ছড়িয়ে দিতে এখন নানা পরিকল্পনা করছেন গবেষকরা।
বিনার উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. রফিকুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে এই জাতটির উদ্ভাবন করেছেন ওই বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামসুল আলম মিঠু। এ ছাড়া সহযোগী গবেষক ছিলেন নাজমুল হাসান মেহেদী।
ইনস্টিটিউট সূত্র জানিয়েছে, নতুন জাত উদ্ভাবনের শুরুর পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ ভারত থেকে বিভিন্ন বরইয়ের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করা হয়। এই জার্মপ্লাজম প্রথমে ইনস্টিটিউটে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু জার্মপ্লাজম সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কাশিয়ারচর গবেষণা মাঠে লাগানো হয়৷
এর মধ্যে দেরিতে ফল ধরে ভারতের এমন একটি জাতকে চিহ্নিত করে ২০১৫ সাল থেকে পুরোদমে গবেষণার পর ২০১৯ সালের শেষদিকে সাফল্য আসে। পরে পরীক্ষামূলকভাবে ২০২০ সালে এক বছর বয়সী একটি গাছ থেকে ২ কেজি বরই উৎপাদন করা হয়। আর দুই বছর বয়সে এই গাছ থেকেই গত বছরের ২৮ এপ্রিলের পর ৪০ কেজি বরই পাওয়া গেছে।
বঙ্গবন্ধু জার্মপ্লাজম সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, উদ্ভাবিত নতুন জাতের গাছগুলোতে থরে থরে ছোট-বড় অসংখ্য বরই ঝুলে আছে। মাঝারি আকৃতির গাছগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে পড়া ডালগুলো ফলের ভারে নুয়ে পড়ছে যেন। তবে সব বরই কাঁচা। কিছু কিছু একেবারেই ছোট। এতে বোঝা যায়, বাজারে ওঠা বরইগুলো শেষ হলেই এগুলোর পাকার সময় হবে। আর এতেই বরইটির কদর বাড়াবে সর্বত্র।
জাতটির উদ্ভাবক ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম মিঠু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে বাজারে দেশীয় কুলের পাশাপাশি বলসুন্দরী, কাশ্মীরি, ভারতকুল, বাউকুল, বারীকুলসহ বিভিন্ন জাতের বরই পাওয়া যায়। এসব কুল শেষ হওয়ার পরও অনেকে সুমিষ্ট জাতের বরই খেতে চান৷ এসব দিক চিন্তা করে গবেষণা শুরু করি এবং ভারতীয় জাতটিতে সাফল্য আসে। এটি হাইব্রিড নয়।’
নতুন বরইয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘টক-মিষ্টি স্বাদের এই বরইয়ের একেকটি বীজের ওজন গড়ে ২ গ্রাম, যা অন্য জাতের চেয়ে খুব কম। আর বরইগুলোর ওজন হবে গড়ে ৭৪ গ্রাম। পাকার সময় এগুলো হলদে ও সোনালী রং ধারণ করে। প্রতিদিন মেয়েদের ৭৫ ও ছেলেদের ক্ষেত্রে ৯০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। ভিটামিন সি শরীরে জমা না থাকার কারণে প্রতিদিন খেতে হয়। উদ্ভাবিত নতুন জাতের এই বরইয়ের প্রতি গ্রামে ৫৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি রয়েছে।’
শামসুল আলম মিঠু জানান, গাছ লাগানোর প্রথম বছরে ২ কেজি ও পরের বছর ৪০ কেজিসহ সময়ের ব্যবধানে একেকটি গাছ থেকে বছরে ৩০০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। আর দেশীয় গাছগুলো যত বছর বেঁচে থাকে, এটিও ঠিক তত বছরই বেঁচে থাকবে।
তিনি বলেন, ‘বাজারে আমরা যে বরইগুলো সাধারণত এখন পাই সেগুলো মার্চ-এপ্রিলেই শেষ হয়ে যায়। নতুন জাতটি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে লাগানো হলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ফুল আসবে এবং মার্চ-এপ্রিলে ফল তোলা শুরু হবে। আর যদি মার্চ-এপ্রিলে লাগানো হয়, তাহলে এপ্রিল-মে মাসে ফল তোলা যাবে। তিন-চারটি ধাপে এই বরই গাছে ধরে। যেমন- কোনোটা একটু বড়, কোনোটা মাঝারি, কোনোটা আবার ছোট। বড়গুলো তোলার পর ছোটগুলোও বড় হতে থাকবে। এভাবে প্রতিটি গাছে তিন মাস পর্যন্ত বরই উৎপাদন করা যাবে।’
এই বরইয়ের চাষাবাদ সম্পর্কে উদ্ভাবক বলেন, ‘এটি বাংলাদেশের সব জায়গায় চাষ করা যাবে। তিন থেকে চার মিটার দূরত্ব রেখে চারা লাগাতে হবে। এর তেমন কোনো রোগবালাই নাই। তবু ফুল আসার আগে একবার কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে ভালো। এ ছাড়া ফুল হওয়ার পর হরমোন জাতীয় প্লানোপিক্স, প্লানোটন বা প্রোরা জাতীয় হরমোন প্রয়োগ করা যেতে পারে।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বরইটি খেতে বেশ সুস্বাদু। যারা খেয়েছে সবাই পছন্দ করেছে।’
তিনি জানান, আগামী মাসের মধ্যেই এই বরইয়ের নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। পরে বাণিজ্যিক চাষের জন্য সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এর স্বাদে আকৃষ্ট হবেন ক্রেতারা, আর লাভবান হবেন চাষিরা।