ইউক্রেনের সমুদ্রবন্দরে নোঙর করে থাকা এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে রকেট হামলায় নিহত থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমানের পরিবার বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
শুক্রবার দুপুরে নিহতের তিন ভাই-বোন ও মা-বাবা গণমাধ্যমের কাছে এ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা।
হাদিসুরের মা রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমি আমার ছেলের মরদেহ ফিরিয়ে আনা ও পরিবারের দুরবস্থার কথা জানাতে রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘আমার চার সন্তানের মধ্যে হাদিসুর মেজো। ওর লেখাপড়া শেষ করতে জমিজমা সব বন্ধক রেখেছি। আমার ওই ছেলের রোজগারে সংসারের ভরণ-পোষণ, বাকি দুই ছেলের পড়াশোনা ও আমাদের চিকিৎসা চলত।
‘আমার দুই ছেলে এখনও পড়াশোনা করছে। হাদিসের মৃত্যুতে ওদের পড়াশোনার খরচা, সংসার চালানো, আমাদের দুজনের চিকিৎসা সব বন্ধ হয়ে যাবে।’
হাদিসুরের মা আরও বলেন, ‘রাশিয়ার ছোড়া রকেটে আমার ছেলে মারা গেছে। আমি রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে রাশিয়া সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই। ওনারা আমার দুই ছেলেকে কর্মসংস্থানের ছেলেকে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলে আমি এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব। নয়তো এই ছেলেদের নিয়ে আমি কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব।’
হাদিসুরের মেজো ভাই তারিকুল ইসলাম তরিক বলেন, ‘বাবা অসুস্থ, বড় ভাই হাদিসুর রহমানই আমাদের অভিভাবক ছিলেন। এমন একটা দিন যায়নি যে আমাদের খোঁজখবর নেননি। আমি, ছোট ভাই প্রিন্স ও মা-বাবার খোঁজ নিতেন নিয়মিত।
‘আমি এখন মাস্টার্স পড়ছি। আমার ছোট ভাই প্রিন্স অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ালেখা করে। আমরা দুই ভাই এখনও বেকার। বড় ভাইয়ের টাকায় পড়াশোনার খরচা চালিয়ে আসছিলাম। এখন সেই ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা দিশেহারা।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করে তারা পরিবারের দুরবস্থার কথা জানাতে চান।
নিহত হাদিসুর রহমানের বড় বোন সানজিদা বলেন, ‘হাদিসুরের কারণে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। ও আমার ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচা, মা-বাবার চিকিৎসাসহ পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাত। এখন আমার এই ছোট দুই ভাইয়ের পড়ালেখার খরচা কে চালাবে।
‘ওদের কী হবে এই চিন্তায় আমি অস্থির। মা-বাবা ভাঙা ঘরে থাকেন, এ বছর আমার ভাই হাদিস ঘর তোলার পরিকল্পনা করেছিল। ওর মৃত্যুতে আমরা দিশেহারা এখন।’
বেতাগী উপজেলার চেয়ারম্যান ও হাদিসুর রহমানের চাচা মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, ‘হাদিসের মৃত্যুতে কার্যত পরিবারের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। নীতিগতভাবে রাশিয়া সরকারের এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো উচিত। এ জন্য পরিবারটির সদস্যরা রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করতে চান। আমার প্রত্যাশা থাকবে, সরকার উদ্যোগ নিয়ে পরিবারের সদস্যদের রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করবে।’
বরগুনা-২ আসনের সংসদ সদস্য শওকত হাচানুর রহমান রিমন বলেন, ‘নিহত হাদিসের পরিবারের খোঁজ নিতে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। দল ও সরকারের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারকে সব রকমের সহায়তা দেয়া হবে।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে মরদেহ উদ্ধার করে হিমঘরে সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং পরিবার যাতে মরদেহ তাড়াতাড়ি ফিরে পায় তার ব্যবস্থা সরকার করবে।
‘নিহত হাদিসের পরিবারকে সব রকমের সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে আমরা সহযোগিতা করব। তাদের ইচ্ছার কথাও আমি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।’
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজ এমভি বাংলা সমৃদ্ধি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে পৌঁছায়। জাহাজটির ইউক্রেন থেকে সিরামিকের কাঁচামাল নিয়ে ইতালিতে যাওয়ার কথা ছিল।
বন্দরে ২৯ জন নাবিক নিয়ে আটকা পড়েছিল জাহাজটি। এর মধ্যে গত বুধবার সন্ধ্যায় রকেট হামলায় জাহাজে মৃত্যু হয় থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমানের।
পরে বৃহস্পতিবার জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ২৮ জন নাবিক ও প্রকৌশলীকে সরিয়ে নেয়া হয় নিরাপদ স্থানে। সরিয়ে নেয়া হয় হাদিসুরের মরদেহও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পোল্যান্ডে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের সরিয়ে নিতে সহযোগিতা করেন।