শুক্রবার সকাল ৯টা ১৫ মিনিট। ঘটনাস্থল কারওয়ান বাজার। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটিতে সেখানে চলে ব্যাপক কেনাবেচা।
কিচেন মার্কেটের নিচতলায় সয়াবিন তেল কিনতে এসেছিলেন একজন। ঢোকেন হাজি স্টোর নামে একটি দোকানে। কিন্তু কেবল তেল কিনতে পারেননি তিনি। দোকানি কামাল গাজী তাকে শর্ত দেন, তেল নিতে চাইলে কিনতে হবে পোলাওয়ের চাল।
প্রথমে শর্ত মানতে রাজি হননি সেই ব্যক্তি। রাগ করে চলে যান দোকান থেকে। কিছুক্ষণ পর আবার ফেরেন দোকানে। দোকানির শর্ত মেনে রূপচাঁদা কোম্পানির দুই লিটার সয়াবিন তেলের সঙ্গে একই কোম্পানির প্যাকেটজাত পোলাওয়ের চাল নিয়ে যান।
প্রথমে দোকানি দাবি করেছিলেন, দুই লিটার তেলের সঙ্গে চাল নিতে হবে দুই কেজি। পরে তিনি কিছুটা নরম হয়ে এক কেজিতে রাজি হন।
বেঁধে দেয়া দামেই কিনতে পেরেছেন সেই ক্রেতা, তবে এ জন্য বাড়তি খরচ করতে হলো ১৩০ টাকা। তিনি চাইলে খোলা পোলাওয়ের চাল কিনতে পারতেন ৯০ টাকা করে, সেখানে সাশ্রয় হতো ৪০ টাকা। তবে সেই সুযোগ ছিল না তার সামনে।
বিক্রেতাকে চাহিদামতো পণ্য না দিয়ে শর্ত বেঁধে দেয়া স্পষ্টত আইনের বিরোধী। তাহলে কেন এই কাজ করলেন- এমন প্রশ্নে দোকানি কামাল গাজী নিউজবাংলাকে বলেন, চাহিদা অনুযায়ী তারা তেল পাচ্ছেন না। যেটুকু পাচ্ছেন সেটুকুর জন্য কোম্পানিও একই ধরনের শর্ত দিচ্ছে। যেমন পুষ্টি কোম্পানির তেল পেতে হলে তাদের সেই কোম্পানির চা পাতা কিনতে হয়। রূপচাঁদা কোম্পানির তেল পেতে হলে বাড়তি পণ্য হিসেবে নিতে হচ্ছে পোলাওয়ের চাল। ফলে তারাও ক্রেতাদের এই শর্ত দিচ্ছেন।
সেই ক্রেতা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এইগুলো দেখেন, তেল কিনতে আইসা চাল কিনতে হইতেছে।’
বিক্রেতা তখন হাস্যরস করে বলছিলেন, ‘ভাবি খুশি হইয়া যাইব। ভাই পোলার চাল নিয়া বাসায় গেছে।’
এই মন্তব্যে ক্রেতার কণ্ঠে ঝরে পড়ল আরও অসহায়ত্ব। বলছিলেন, ‘আমার বাসায় পোলাওয়ের চাল আছে, এটা দরকার নেই।’
১ মার্চ থেকে সয়াবিন তেল লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করতে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব সরকার ফিরিয়ে দেয়ার পর থেকে রান্নার উপকরণটির বাজার স্বাভাবিক নয় মোটেও।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারিতে সরবরাহ কমে গছে, পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফ্যাক্টরি থেকে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে না, তবে কারখানা মালিকরা স্বীকার করছেন না।
অতীতে নানা সময় একই ধরনের পরিস্থিতি যখন তৈরি হয়েছে, তখনও এই বক্তব্যগুলোই এসেছে গণমাধ্যমে। শেষ পর্যন্ত চাপটা গিয়ে ঠেকে ভোক্তাদের ঘাড়ে, যাদের আসলে তখন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি টাকায় কিনতে হয়।
অন্য একটি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, ক্রেতারা দুই বা তিন কনটেইনার তেল চাইলে তাদের একটি দিতে বলছেন বিক্রেতা।
আলী স্টোরের স্বত্বাধিকারী আলী আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেকেই আইসা পাঁচ লিটারের তিনটা-চারটা বোতল নিতে চান। তাগোরে কইছি, আপনাগো সব দিয়া দিলে অন্য কাস্টমারগো কী দিমু? আস্তে ধীরে নেন। শেষ হইলে আবার নিয়েন।’
কারওয়ান বাজারে খুচরা বিক্রেতা ওমর ফারুক জানান, তাদের যে পরিমাণ পণ্যের দরকার, সে পরিমাণ তেল সরকার ও কোম্পানিগুলো দিচ্ছে না। বলেন, যারা বেশি দাম দিয়ে কিনছেন, শুধু তাদেরই দেয়া হচ্ছে, কখনও কখনও বোতলে গায়ের মূল্যে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু ক্রেতা ধরে রাখতে এটা করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে না খোলা তেল
বোতলজাত সয়াবিন তেল নানা শর্তে তাও পাওয়া যাচ্ছে, তবে খোলা তেলের ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। তেল রেখে কারও পক্ষে ক্রেতাদের না করার সুযোগ নেই। তবে তেল চেয়ে না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
খোলা সয়াবিন তেলের ভোক্তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন খাবার হোটেল বা নিম্ন আয়ের মানুষ অথবা নিম্ন আয়ের মানুষদের কাছে বিক্রি করেন- এমন ছোট দোকানি।
কিন্তু কয়েক দিন ধরে দেখা গেছে, বিক্রেতারা তেল নেই বলে ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিচ্ছেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযানে কারওয়ান বাজারের একাধিক বিক্রেতাকে এই অভিযোগে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা, ১৫ দিন দোকান বন্ধের সাজাও দেয়া হয়েছে।
খোলা তেলের দাম নিয়ে একটু বিভ্রান্তি অবশ্য আছে। সরকার ঠিক করে দিয়েছে খোলা সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য হবে লিটারে ১৪৩ টাকা আর সুপার পাম তেলের দাম ১৩৩ টাকা।
কিন্তু কারওয়ান বাজারে খোলা সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা আর সুপার পামঅয়েল ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এর কারণ জানতে চাইলে ব্যবসায়ীরা বলেন, সরকার দাম ঠিক করেছে লিটারে, কিন্তু এখানে বিক্রি হয় কেজি দরে। এক কেজি তেল এক লিটারের চেয়ে কিছুটা বেশি। এ কারণে দামে পার্থক্য।
নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় রিকশাচালক সুজন মিয়ার সঙ্গে। আধা কেজি খোলা সয়াবিন কিনতে তাকে ব্যয় করতে হয় ৮৫ টাকা।
তিনি বলেন, ‘এমনি চললে তো আমরা বাজার কইরা খাইতে পারমু না। হুনছি বোতলের কেজি নাকি ২০০ টাকা হইছে। তাই খোলা তেল নিলাম।’
সমিতির নেতা জানালেন দুই কোম্পানির সরবরাহ বন্ধ
ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলছেন, দুটি কারখানা থেকে সরবরাহ নেই।
কোন দুই কারখানা?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘টি কে গ্রুপের নেই। ফ্রেশের নেই। জাহাজে মাল আসতেছে বলেছে।’
টি কে গ্রুপ পুষ্টি নামে সয়াবিন তেল বাজারজাত করে আর ফ্রেশ নিজের নামেই বাজারে তেল ছাড়ে।
এই সংকট থাকবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দু-এক দিনের ব্যাপার।’
সরকার তেলের দাম ১২ টাকা বাড়াতে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব নাকচ করলেও গোলাম মওলা বলছেন, বাড়ানো উচিত ছিল।
তিনি বলেন, ‘সমন্বয় করতে হবে তো। আপনি কিনে আনবেন ১০ টাকায়, বিক্রি করবেন ৮ টাকায় তাহলে তো মাল আনবেন না।’
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ক্রমেই বাড়ছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধপরিস্থিতি এই বাজারকে আরও তাতিয়ে দিচ্ছে।
তাহলে সমাধান কী হতে পারে?- গোলাম মওলা বলেন, ‘সরকার যদি ভ্যাট বাতিল করে তাহলে কিছুটা সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া ভোজ্যতেলের দাম কমানোর বিকল্প কোনো পথ নেই।’
সংকট আছে, দাম বাড়ালে ঠিক হবে: সিটি গ্রুপ কর্মকর্তা
ব্যবসায়ীদের অভিযোগের বিষয়ে তেল বিপণনকারী কোম্পানি সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ কুমার সাহা নিউজবাংলার কাছে স্বীকার করেছেন বাজারে সরবরাহ সংকট আছে। আর দাম বাড়ানোই এর সমাধান বলে মনে করেন তিনি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাজারে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে আমার যা উৎপাদন হচ্ছে পুরোটাই ডেলিভারি হচ্ছে।’
তেলের সরবরাহ কেমন- এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তারা প্রতিদিন ২ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টন বাজারে ছাড়ছেন। বলেন, ‘আমারটা আমি বলে দিলাম। অন্যেরটা জানি না।’
রমজানে ভোজ্যতেলের সংকট হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তেলের দাম ১২ টাকা বৃদ্ধির যে প্রস্তাব সেটা মেনে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে কারণ সবাই তো জানে দাম বাড়বে।’