ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গির হরিণমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সীমানা প্রাচীরে ঘেরা বিদ্যালয়ের মাঠটি। কিন্তু একি! মাঠভর্তি সবুজ বাড়ন্ত গমের চারা। দানা বাঁধতে শুরু করেছে গম। কিছুদিন পর সেই গম কাটার সময় হবে।
যেখানে শিশু শিক্ষার্থীদের মেধা ও মনন বিকাশের সহায়ক হিসেবে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে দোলনা ও স্লিপারসহ বিভিন্ন বিনোদন সামগ্রী বসানো হচ্ছে, সেখানে ঠাকুরগাঁওয়ের এই স্কুলের মাঠে দেখা গেল গমের আবাদ।
এমন পরিস্থিতিতে পাঠ বিরতির সময় বিদ্যালয়ের বারান্দাটিই খেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে শিশু শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ছোট্ট বারান্দায় একসঙ্গে খেলতে না পেরে বারান্দায় যেন বন্দী অধিকাংশ কোমলমতি শিশুরা।
এদিকে এ কারণে শিশু শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে চায় না বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বিদ্যালয়ের পুরো মাঠ গমের চারায় পূর্ণ। প্রথম দেখায় যে কারো মনে হবে এটি একটি ফসলি মাঠ। বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে থাকা শহীদ মিনার ঘেঁষেই একটু জায়গা রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য। নেই কোনো খেলার জায়গা।
এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক মতি মিয়া বলেন, ‘একটি স্কুলের পরিবেশ এমন হলে আমাদের সন্তানদের কি শিখতে সেখানে পাঠাব। খেলার জায়গা না থাকায় আমার সন্তান স্কুলে যেতে চায় না। আমি গরীব মানুষ, গ্রামের এই স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও পড়ানোর সামর্থ্য নাই। তাই জোর করেই সন্তানকে এমন জায়গায় পাঠাতে হয়।’
পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, ‘মাঠে খেলতে চাই। গমের চাষ করায় আর খেলতে পারি না। বারান্দায় একটু খেলা যায়।’ কিন্তু সেখানে সব সহপাঠীরা একসঙ্গে খেলতে পারে না জানিয়ে এ শিক্ষার্থী দাবি জানাল, বিদ্যালয়ের মাঠটি তাদের খেলার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার।
অভিভাবক শিরিন আক্তার বলেন, ‘স্কুলের পরিবেশ ঠিক রাখতে পারলে শিশুরা উৎসাহিত হবে। তারা বিদ্যালয়ে যেতে আগ্রহী হবে। কিন্তু এখানে সেই সুযোগ নেই। তাই আমাদের সন্তানরা বিদ্যালয়ে যেতে চায় না।’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ১৯৫৪ সালে গ্রামের শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৫৪ সালে স্থানীয় সমাজ সেবক খোস মোহাম্মদ ও তার তিন ভাই মিলে হরিণমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ২.৩ একর জমি দান করেন। তবে সম্প্রতি দাতাদের উত্তরসূরি ১৮ জন নাতি-নাতনি গমের চাষাবাদ করা স্কুলমাঠের অংশটুকু নিজেদের বলে দাবি করছেন। তাই জমি দখলে রাখতেই সেখানে আবাদ গম শুরু করেছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় বাসিন্দা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৮ জন উত্তরসূরির মধ্যে স্কুলের জমি সংক্রান্ত বিষয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ওয়াহিদুজ্জামান নামের এক উত্তরসূরি। তার দাবি, স্কুলের মাঠে দান করা জমি ছাড়াও তাদের কিছু জমি রয়েছে। তাই তারা জমিটি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারাই অন্য কৃষককে দিয়ে এখানে চাষাবাদ শুরু করেছে।’
এ সময় বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে বাচ্চাদের খেলা বন্ধ রাখার বিষয়টি অমানবিক ও অনৈতিক বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে জমির উত্তরসূরি দাবিদার ওয়াহিদুজ্জামানের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তিনি গণমাধ্যমে কথা বলতে রাজি হননি। এছাড়া গম আবাদকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউই এ বিষয়ে কোনও কথা বলেননি।
হরিণমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনজুমান আরা বেগম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমানে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৯২ জন। বিদ্যালয়ের জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জমির দাবিদারদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি এবং সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা চলছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘গম আবাদ শুরু করার সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হলেও এ বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’
প্রাথমিকের ভারপ্রাপ্ত বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তা আজমল আজাদ নিউজাবংলাকে বলেন, ‘একটি বিদ্যালয়ের মাঠে শিক্ষার্থীদের খেলাকে বাধাগ্রস্থ করে গম চাষ কাম্য নয়। করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় শুরুতেই বিষয়টি আমি জানতে পারিনি। দুদিন আগে জেনেই ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যােগ নিয়েছি।’
তবে গম চাষাবাদের শুরুতে বিষয়টি কেউ জানায়নি দাবি এ শিক্ষা কর্মকর্তার। এখানে সহকারী শিক্ষা অফিসার ও প্রধান শিক্ষকের গাফিলতি আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।