কথায় বলে, টাকা দেখলে কাঠের পুতুলও হা করে। আবার অনেকে বলেন, অর্থই অনর্থের মূল। অথচ টাকা ছাড়া অর্থনীতি চলে না।
বিনিময় মাধ্যম হিসেবে টাকার বিকল্প নেই। কেনাকাটা কিংবা প্রয়োজনে টাকাই একমাত্র অবলম্বন। সাধারণভাবে টাকা হলো কোনো পণ্য ক্রয়-বিক্রয় বা সেবা গ্রহণ বা ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধের উপাদান। টাকা প্রধানত বিনিময়ের মাধ্যম, আয়-ব্যয়ের একক, মজুত দ্রব্যের মূল্য এবং বিভিন্ন সেবা পরিশোধের মান হিসেবে কাজ করে।
অন্যভাবে বলা যায়, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এবং মুদ্রিত মুদ্রা ব্যবস্থাই টাকা, যা সরকার যতক্ষণ চাইবে ততক্ষণ প্রচলিত বিনিময়মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। সরকার ঠিক যে মুহূর্তে এর ওপর থেকে অনুমোদন সরিয়ে নেবে, তখনই তা মামুলি কাগজে পরিণত হবে। সুতরাং বলা যায়, টাকা অনুমোদিত কাগজের টুকরা মাত্র, যা অন্যের দয়ার ওপর নির্ভরশীল।
একেক দেশের মুদ্রার নাম একেক রকম। তাই প্রশ্ন জাগে, আমাদের মুদ্রার নাম ‘টাকা’ হলো কীভাবে।
টাকা শব্দটিকে আমাদের ‘ভাষার বিকাশের ইতিহাস’ হিসেবেও দেখা যায় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, “বাংলা ভাষার শিকড় দুটি: প্রাকৃত ও সংস্কৃত। এ দুটি ভাষায় একটা শব্দ ছিল ‘টংকা’। সংস্কৃত ও প্রাকৃত দুটিতেই ‘টংকা’ শব্দটি থাকায় সেখান থেকে টাকা শব্দটি এসেছে। কারণ শব্দটি আমাদের ভাষার শিকড়ে রয়েছে। এ জন্য ডলার, ইউরো অন্য কোনো নাম হওয়ার সুযোগ নেই।”
তিনি আরও বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মুদ্রার নাম রুপি। কিন্তু পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় রুপিকে টাকা বলে। কারণ, টাকা শব্দটি শিকড়ের মধ্যে আছে। ভাষার যে শিকড় তার মধ্যে আছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, “পাকিস্তানি আমলে সবাই রুপি বললেও তখনও আমরা টাকা বলতাম। টাকা শব্দটি বাংলা। স্বাধীনতার পর নতুন সরকার এসে বাংলা শব্দ ‘টাকা’কে মুদ্রার নাম হিসেবে গ্রহণ করে। ডলারের মতো টাকারও একটা চিহ্ন আছে। টাকা শুধু মুদ্রা নয়, আমাদের সংস্কৃতির অংশ।”
টাকা শব্দের উৎপত্তি
মূলত সংস্কৃত ভাষা থেকে উদ্ভব ‘টাকা’ শব্দের। সংস্কৃত শব্দ ‘টঙ্ক’, যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। পরবর্তী সময়ে নামকরণ হয় টাকা। আগে যেকোনো ধরনের মুদ্রা বা ধাতব মুদ্রা বোঝাতে টাকা শব্দটির প্রচলন ছিল। অর্থাৎ টাকা দিয়ে সব সময়ই অর্থকে বোঝানো হয়েছে। চতুর্দশ শতকের শুরুতে বাংলায় এর প্রচলন শুরু হয়। বাংলা ভাষার একটি অংশ হিসেবে সব ধরনের কারেন্সি বা নোট বা মূলধন বোঝাতে ব্যবহার করা হয় ‘টাকা’ শব্দ।
মুদ্রার জন্মের ইতিহাস
স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন থাকার যুগে ধাতুর তৈরি টাকা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এ ধরনের টাকা ক্ষয় হয়ে যেত এবং এর পরিমাণ কমে যেত, অন্য দিকে অনেক পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা পরিবহন করা ঝুঁকি এবং খুবই কষ্টসাধ্য কাজ ছিল।
এরপর মানুষ স্বর্ণকারের কাছে স্বর্ণ রেখে একটা স্লিপ বা রসিদ নিয়ে আসত। এই রসিদ অনেকটা চেকের মতো কাজ করত। লেনদেনের সময় রসিদ ধরিয়ে দিত এবং সেই রসিদ ওই স্বর্ণকারের কাছে জমা দিলে স্বর্ণকার তাকে ধাতুর মুদ্রা দিতে বাধ্য থাকত। কারণ সেই রসিদে এই কথাটা লেখা থাকত: ‘চাহিবামাত্র ইহার বাহককে মুদ্রা দিতে বাধ্য থাকিবে।’
এরপর আধুনিকায়ন এবং জাতীয়করণের ফলে এটা কাগজের মুদ্রা কিংবা টাকায় পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে যেভাবে আসে টাকা
দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগ থেকেই ‘টাকা’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত এ দেশের মানুষ। টাকার আনুষ্ঠানিক যাত্রা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হলেও ১৯৪৭ সাল থেকে দেশে প্রচলিত পাকিস্তানি রুপিকে এ দেশে কাগজে-কলমে টাকাও বলা হতো।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি রুপির একপাশে ‘বাংলা দেশ’ এবং অপর পাশে ইংরেজিতে ‘বাংলা দেশ’ লেখা রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো। ১৯৭১ সালের ৮ জুন পাকিস্তান সরকার এই রাবার স্ট্যাম্পযুক্ত টাকাকে অবৈধ এবং মূল্যহীন ঘোষণা করে। এর পরেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ পর্যন্ত এই রাবার-স্ট্যাম্পযুক্ত পাকিস্তানি টাকা চলেছিল সারা দেশে।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নতুন মুদ্রা প্রচলন শুরু হয়। তাতে সময় লেগেছিল তিন মাসের মতো। তাই ওই সময়ে পাকিস্তানি রুপিই ব্যবহৃত হতো।
১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বাংলাদেশি কারেন্সিকে ‘টাকা’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম কোষাগার মুদ্রা বের করা হয় ১ টাকার নোট। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এ নোটের প্রচলন ছিল।
বাংলাদেশি মুদ্রা কেন দুই ধরনের
দেশে প্রচলিত মুদ্রা দুই ধরনের। একটি সরকারি টাকা বা সরকারি মুদ্রা। অপরটি ব্যাংক নোট।
সরকারি মুদ্রা হলো: ১ টাকা, ২ টাকা এবং ৫ টাকা। এর বাইরে সব নোটই ব্যাংক নোট।
ব্যাংক নোট বাংলাদেশ ব্যাংক বের করে বলে এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের স্বাক্ষর থাকে। কিন্তু সরকারি নোট বের করে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়। এ জন্য এতে থাকে অর্থসচিবের সই।
এর বাইরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান, স্থান ও ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ বিভিন্ন সময়ে স্মারক মুদ্রা, নোট ও ফোল্ডার দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মুদ্রণ করে।
এসব স্মারক মুদ্রা ও নোট বিনিময়যোগ্য নয়।
টাকা ছাপা হয় যেভাবে
টাকশাল বা দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন লিমিটেড থেকে ছাপানো হয় টাকা। এই টাকশাল গাজীপুরে অবস্থিত। টাকশাল বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৯ সালে টাকশালের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
টাকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগ পর্যন্ত ভারত, সুইজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি থেকে বাংলাদেশের নোট ছেপে আনা হতো। তবে নোট ছাপানোর যাবতীয় উপকরণ কাগজ, কালি, রং, নিরাপত্তা সুতা ইত্যাদি এখনও বিদেশ থেকে আমদানি হয়।
টাকার ভবিষ্যৎ
বর্তমানে কাগুজে টাকার ব্যবহার অনেক কমেছে। মানিব্যাগ অথবা পকেট ফুলিয়ে টাকা রাখার যে প্রবণতা একসময় ছিল, এখন সেই ধারণা থেকে বের হয়ে আসছে সবাই। বড় প্রতিষ্ঠানের সিইও থেকে শুরু করে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক পর্যন্ত লেনদেনে কার্ডের দিকে ঝুঁকছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান আরও বলেন, ‘টাকা আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কারণ, ঈদের সময় নতুন নোট বাজারে ছাড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ, তখন কাগুজে নোটের চাহিদা বাড়ে।’
তিনি আরও বলেন, “টাকার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য ‘টাকা জাদুঘর’ করা হয়েছে। সেখানে শুধু যে মুদ্রা প্রদর্শন হয় তা নয়, কোন টাকার কবে কীভাবে উদ্ভব হয়েছে, সেটার বিবরণও দেয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতির বিবর্তনের সঙ্গে টাকার ব্যবহারেও বিবর্তন হয়েছে। এখন কাগুজে টাকার ব্যবহার কমেছে। ডিজিটাল মুদ্রায় ঝুঁকছে সবাই।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একসময় বিনিময় মাধ্যম ছিল কাগুজে টাকা। কিন্তু এখন বিকল্প বের হয়েছে। ফলে আগের তুলনায় নগদ টাকার ব্যবহার কমেছে। তবে আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ নগদ টাকা পছন্দ করে। চেক বা কার্ডে লেনদেন অনেকে করতে চায় না। এ জন্য আমাদের কারেন্সি বেশি প্রয়োজন হয়।’