ছোট থেকেই বই পড়তে ভালোবাসেন বগুড়ার খান্দার এলাকার বাসিন্দা জিয়াউল হক। নিজের সংগ্রহেও রয়েছে কয়েক শ বই। তবু ৬৭ বছর বয়সেও উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছেন এই পাঠক। এখানকার সদস্যও তিনি।
জিয়াউল হক বলেন, ‘বগুড়ার উডবার্ন লাইব্রেরি অনেক পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী ও সমৃদ্ধশালী পাঠাগার। এখানে ভ্রমণ ও পাখিবিষয়ক বইগুলো বেশি পড়ছি। একটা সময়ে আমার চাচাতো ভাইরাও এসেছেন। তাদের দেখে আমিও পাঠাগারমুখী হয়েছি।’
শুধু জিয়াউল হক নয়। পৌনে ২০০ বছরের পুরোনো উডবার্ন সরকারি লাইব্রেরি থেকে বই পড়ে আলোকিত বগুড়ার অসংখ্য মানুষ।
প্রায় সাড়ে ৪৮ হাজার বই ও পত্রিকা নিয়ে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য এই লাইব্রেরি বিদ্যাচর্চার জন্য অবারিত স্থান। প্রতি মাসে গড়ে দেড় হাজার পাঠক নিয়মিত এই সেবা নিয়ে আসছেন।
সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অমৃত কুমার মণ্ডল। তার বাড়ি নওগাঁর পত্নীতলায়। বগুড়ার সাতমাথা এলাকায় মেসে থাকেন। চাকরির জন্য পড়াশোনা করছেন।
তিনি বলেন, ‘উডবার্ন লাইব্রেরির পরিবেশ খুব সুন্দর। এখানে এসে অনেক উপকৃত হই। কারণ এখানে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি মূলত অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা করি। পাশাপাশি এখানে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। সেখানেও টাইপের চর্চা করতে পারি, যা দোকানে ব্যয়বহুল।’
আজিজুল হক কলেজের আরেক সাবেক শিক্ষার্থী লিপি আক্তার প্রতিদিন আসেন শেরপুর উপজেলা রানীরহাট এলাকা থেকে। তিনিও চাকরিপ্রত্যাশী হিসেবে গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক।
লিপি জানান, বাড়িতে পড়ালেখার তেমন পরিবেশ পাওয়া যায় না। এখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়া যায়। এ জন্য উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারে আসা।
চাকরিপ্রত্যাশীদের বাইরে বিনোদনের জন্য বই পড়ার মতো পাঠক আগের থেকে কিছুটা কমেছে। এর কারণ হিসেবে বেশির ভাগই কিশোর-তরুণদের মোবাইলে বা ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহকে দায়ী করছেন পাঠক ও গ্রন্থাগারের কর্মকর্তারা।
জিয়াউল হক বলেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ার প্রতি উদাসীন। তারা মোবাইল, ল্যাপটপ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এ বিষয়ে সরকারকে আরও সচেতন হওয়া উচিত। যাতে তরুণরা বইয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।’
এর মাঝেও অনেক শিক্ষার্থীকে দেখা যায় প্রাতিষ্ঠানিক সিলেবাসের বাইরের বই পড়তে। গ্রন্থাগারে পাওয়া যায় এমন এক শিক্ষার্থীকে। নাম আশিক রহমান। তিনি বগুড়া সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রায় সাত মাস ধরে এই গ্রন্থাগারে আসছেন তিনি।
আশিক জানান, তার এক শিক্ষকের কাছ থেকে এই উডবার্ন গ্রন্থাগারের খোঁজ পান। এর পর থেকে আসা-যাওয়া শুরু। এখানে বিভিন্ন উপন্যাস ও ছোটগল্প পড়েন তিনি।
৩০০ বছরের পুরোনো তিনটি পাণ্ডুলিপি। ছবি: নিউজবাংলাকী রয়েছে
পাঠাগারের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি এ গ্রন্থাগারের রেজিস্টারভুক্ত বই রয়েছে ৪৮ হাজার ৩৯২টি। এর মধ্যে বাংলা বই রয়েছে ৪৪ হাজার ৪৫টি। ইংরেজি ৪ হাজার ২৭০টি এবং অন্যান্য আরও ৭৭টি বই রয়েছে পাঠাগারে।
এ ছাড়া দৈনিক বাংলা পত্রিকা ১০টি ও দৈনিক ইংরেজি একটি, বাংলা সাময়িকী আটটি, ইংরেজি সাময়িকী একটি নিয়মিত কেনা হয়।
এখানে প্রায় ৩০০ বছরের পুরোনো তিনটি পাণ্ডুলিপি রয়েছে। সেগুলো হলো পদ্মপুরান, গোবিন্দকথামৃত ও হিরণ্যকশিপুর। এগুলো কার মাধ্যমে এখানে এসেছে তার সঠিক তথ্য নেই।
পাঠক কেমন
জানুয়ারিতে ১ হাজার ৫৬০ জন পাঠাগারে বই ও পত্রিকা পড়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ পাঠক ১ হাজার ৩৫৮ জন। আর নারী পাঠক ১৭৪ জন।
ফেব্রুয়ারিতে পাঠকের এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৩৭। এর মধ্যে পুরুষ ২ হাজার ১৩৯, নারী ৩৬২ ও শিশু ৩৬।
ধারে বা বই ইস্যু নেয়ার সদস্য রয়েছেন ৩৩১ জন, যারা নিয়মিত বই বাসায় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন।
কী বলছেন লাইব্রেরির কর্মকর্তারা
উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান আমির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে যে কয়েকটি প্রাচীন লাইব্রেরি রয়েছে, তার মধ্যে উডবার্ন অন্যতম। প্রায় দেড় শ বছরের বেশি এই লাইব্রেরিতে অনেক পুরোনো ও রেফারেন্স বই এবং কিছু পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
‘এমন প্রাচীন সংগ্রহ সাধারণত অন্য লাইব্রেরিতে নেই। এসব বইয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন অসংখ্য পাঠক সেবা নিচ্ছেন। পাঠকের উপস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। গবেষক, শিক্ষার্থী ও কবি-সাহিত্যিক এখানে সেবা নিয়ে থাকেন।’
আমির হোসেন আরও বলেন, ‘এই পাঠকসেবা আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে আগামীতে দেশব্যাপী লাইব্রেরিগুলোকে ডিজিটাল করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৭১টি জেলা ও উপজেলার লাইব্রেরি ডিজিটাল করা হবে।’
শুরু যেভাবে
বগুড়া শহরের কেন্দ্রবিন্দু এলাকার এডওয়ার্ড পৌর পার্কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগার। ২০০০ সালে ৪০ শতক জমির ওপর স্থাপন করা হয়েছে চারতলা ভবনের এই গ্রন্থাগার। তবে এটি একটি আধুনিক গ্রন্থাগার। এটির জন্মের ইতিহাস আরও পুরোনো।
লাইব্রেরির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যে জানা গেছে, পুরাতন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি ১৮৫৪ সালে জেলার খ্যাতনামা ব্যক্তিদের প্রচেষ্টা ও সহায়তায় রয়েল উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপন করেন।
প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর বগুড়ার নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান চৌধুরী লাইব্রেরির জন্য একটি নতুন ভবন নির্মাণ করেন। ১৯০৮ সালে জে এন গুপ্ত জেলা কালেক্টর সে সময়ের বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জন উডবার্নের নাম অনুসারে এই লাইব্রেরির নামকরণ করেন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি।
উডবার্ন লাইব্রেরির প্রধান ফটক। ছবি: নিউজবাংলাযেসব কবি-সাহিত্যিক এসেছিলেন
ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর বড় ভাই শরৎচন্দ্র বসু, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি কিরণ শংকর দাসের মতো ব্যক্তিরা এসেছিলেন এই লাইব্রেরিতে।
সরকারীকরণ যেভাবে
সময়ের বিবর্তনে উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা শোচনীয় হয়। পরে পাঠাগারটি সরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯৮৪ সালে স্থাপিত বগুড়া জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ওই সময় পাঠাগারটি সে সময় ছিল শহরের শিববাটি এলাকায়।
১৯৯৬ সালের জুনে একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় সবার সিদ্ধান্তে এই লাইব্রেরিকে সরকারি গ্রন্থাগার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর পর থেকে এটির নাম হয় উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগার।
পরে পার্কের পশ্চিমে নির্ধারিত স্থানে নির্মাণ হয় ভবন। ২০০৪ সাল থেকে এই গ্রন্থাগার পুরোদমে চালু হয়।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারের লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট আনিসুল হক। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি গ্রন্থাগারে কর্মরত।
আনিসুল হক বলেন, ‘১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে এসে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই পাবলিক লাইব্রেরির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। তখন ওই লাইব্রেরি ছিল পৌর পার্কের ভেতর। তাদের অনেক বই, আলমারি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে এটি সরকারীকরণ হওয়ার পর আমরা পুরোনো লাইব্রেরির বইগুলো নিয়ে আসি।’
লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট আরও বলেন, ‘সে সময় অন্তত সাড়ে ৮ হাজার বই নতুন গ্রন্থাগারে আনা হয়। কিন্তু তাদের তালিকায় প্রায় ২৫ হাজার বই ছিল। যেগুলোর মধ্যে অনেক বই নিখোঁজ ছিল। এ ছাড়া প্রচুর বই একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।’
সংকট
বিপুল বইয়ের সমাহারে সমৃদ্ধশালী এই লাইব্রেরিতে রয়েছে জনবল সংকট। উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগারে পদ রয়েছে ৯টি। এর বিপরীতে লাইব্রেরিতে কর্মরত তিনজন। সহকারী লাইব্রেরিয়ান, লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট ও নৈশপ্রহরী।
সম্প্রতি রিডিং হল অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে লুৎফর রহমান নামে একজন এখানে কর্মরত। তবে তিনি সংযুক্তিতে এখানে কাজ করছেন। তার মূল কর্মস্থল রাজশাহীতে। আর আউটসোর্সিং হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন রিপন মিয়া।
জ্যেষ্ঠ লাইব্রেরিয়ান, কম্পিউটার অপারেটর, টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট, বুকসর্টার, অফিস সহায়ক, চেকপোস্ট অ্যাসিসট্যান্ট পদ দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে।
লাইব্রেরি অ্যাসিসট্যান্ট বলেন, ‘উডবার্ন সরকারি গ্রন্থাগার হওয়া থেকেই এখানে জনবল সংকট রয়েছে। ওই পদের কাজগুলো আমরাই করে থাকি।’
সহকারী লাইব্রেরিয়ান আমির হোসেন বলেন, ‘প্রাচীন লাইব্রেরি হলেও এখানে পাঠকসেবা ঠিকমতো দেয়া যায় না। কারণ এখানে ৯টি পদের বিপরীতে তিনজন ব্যক্তি আছি। প্রায় সাড়ে ৩০০ সদস্য ও বিপুল বই থাকায় এই তিনজন নিয়ে পাঠকদের সেবা দেয়া কষ্টকর। এখানে জনবল বাড়ালে আমরা পাঠকদের আরও বেশি সেবা দিতে পারব।’