‘হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে ভাইয়ার সাথে আমি যখন কথা বলছিলাম তখন রাত সাড়ে ৮টা। সম্ভবত কথা বলার জন্যই ভাইয়া জাহাজের উপরে উঠেছিলেন। ভাইয়া আমার পড়াশোনার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। মায়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না, মায়ের চিকিৎসার খোঁজ নিচ্ছিলেন।
‘হঠাৎ বিকট শব্দ। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ধারণা করছি ওই সময়ই জাহাজে রকেট আঘাত হানে। পরে সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি ওই জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার ভাইয়া আর বেঁচে নেই।’
ইউক্রেনের অলিভিয়া বন্দরে নোঙর করে থাকা বাংলাদেশের জাহাজ ‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে রকেট হামলায় নিহত হাদিসুর রহমানের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্স বলছিলেন কথাগুলো। সে হিসাবে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুরের সঙ্গে সবশেষ কথা হয় ছোট ভাই প্রিন্সের।
বরগুনার বেতাগী কদমতলা গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে হাদিসুর বড়। বেতাগী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক ও বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। এরপর ২০১১ সালে চট্টগ্রামের মেরিন একাডেমিতে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে মেরিন একাডেমি থেকে প্রকৌশলী হয়ে বের হয়ে চাকরিতে যোগ দেন হাদিসুর।
বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন হাদিসুর। এ সময় আরেক ভাই তারিকুল ইসলাম তারিক বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান।
বেতাগীর কদমতলা গ্রামের বাড়িতে সন্তানহারা বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনরা। ছবি: নিউজবাংলা
বাবা আবদুর রাজ্জাক স্থানীয় নাদেরিয়া দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। ২০১৫ সালে তিনি অবসর নেন। সামান্য বেতনের চাকরি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে গিয়ে জমিজমা সব বন্ধক পড়েছে। কিছু বিক্রিও করতে হয়েছে। সম্বল বলতে বড় ছেলে হাদিসুরের চাকরি ও পুরনো কাঠের ঘর ছাড়া কিছুই নেই।
চাকরিতে যোগদানের পর পরিবার ও দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ যোগানোর চিন্তা থেকে বিয়ের কথাও ভাবেননি এই মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। কথা ছিল এবার বাড়ি ফিরলে নতুন ঘর নির্মাণ ও বিয়ে আয়োজনের কথা ছিল। সেজন্য পরিবারের সদস্যরা কনের খোঁজখবরও করছিলেন।
বৃহস্পতিবার সকালে বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলায় হাদিসুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা মানুষের ভিড়। বাবা আবদুর রাজ্জাক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছেলে হাদিসুরকে খুঁজছেন। কিছু সময় পর পর বলছেন, ‘মোর পোলাডারে মোর দাওে এট্টু আইন্না দেন, মুই ওর মুকটা একফির দেহি?’
মেঝেতে বসে বিলাপ করছেন হাদিসুরের মা রাশিদা বেগম। বুধবার সকাল ৮টার দিকে মায়ের সঙ্গে সবশেষ কথা হয় হাদিসুরের। সে সময় মায়ের শরীরের খোঁজ নিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘মা, তুমি বেশি করে খাও। আমি দেখব তুমি কতগুলা ভাত খাইতেছ।’
কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রাশিদা বেগম। কান্না থামিয়ে বলেন, মুই আর কিছছু চাই না, মোর পোলাডার মুকটা শ্যাষবারের মতন একটু দ্যাকতে দেন। মোর শরীরডা ভালো না, ওর বাফেরও অসুখ। ও মইর্যা গ্যাছে। এহন মোগেও মরণ ছাড়া উপায় নাই।’
মেঝো ভাই তারিকুল স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী। ছোট ভাই প্রিন্স স্নাতক বর্ষে অধ্যয়নরত। ভাই হারিয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন তারা।
একমাত্র বোন সানজিদার বিয়ে হয়েছে জেলার আমতলী উপজেলায়। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে বাবার বাড়িতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সানজিদা বিলাপ করে বলছিলেন, ‘তিনডা ভাইর আমি একটা বুইন। প্রতিদিনই ও আমার খোঁজ-খবর নিত। বিয়ার কথা বলছিলাম। বলছিল, আপা এইবার সেপ্টেম্বর মাসে বাড়িতে আইসা ঘর উডাইয়া বিয়া করমু। আহারে আমার ভাই…।’
নিহত হাদিসুর রহমান বেতাগী উপজেলা চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকানের চাচাত ভাইয়ের ছেলে। ফোরকান বলেন, হাদিসের মরদেহ আনার বিষয়ে বরগুনার দুজন সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলাপ করেছি। তবে তারা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘হাদিসুরের মরদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এই মুহূর্তে ইউক্রেনে যে অবস্থা চলছে, নিশ্চিত করে আমরা বলতে পারছি না তার মরদেহ কবে নাগাদ দেশে আনা সম্ভব হবে।’
‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজটি ২১ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের বন্দর এরেগলি ছেড়ে যায়। সেটি ২৩ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বন্দর অলিভিয়ায় পৌঁছে। রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ইউক্রেনে পরিস্থিতির অবনতি হলে শিপিং করপোরেশনের নির্দেশে পণ্য লোড করার পরিকল্পনা বাতিল করে সেখানেই জাহাজটিকে অবস্থান করছিল।
বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ৯টা ২৫ মিনিটে যুদ্ধবিমান থেকে রকেট হামলায় জাহাজের ডেকে আগুন ধরে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন জাহাজের ক্রু ও নাবিকরা। ওই হামলায় নিহত হন জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান।