পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস দেশে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যে হারের কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছে, প্রকৃত হার তার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি বলে দাবি করেছে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠন।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং- সংক্ষেপে সানেম নামে এই সংগঠনটি দাবি করেছে, শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার এখন ১২ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গ্রামে এই হার ১২ দশমিক ১০ শতাংশ।
তবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিবিএস যে হিসাব প্রকাশ করেছে তাতে দাবি করা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আগের মাস ডিসেম্বরে এই হার ছিল ৬ শতাংশের ওপরে; ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
নিত্যপণের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রার মধ্যে বিবিএসের এই পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আগেই সংশয়ের কথা বলেছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এবার সানেমের একটি গবেষণায় কিছু তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার ‘মূল্যস্ফীতি : সরকারি পরিসংখ্যান বনাম প্রান্তিক মানুষের বাস্তবতা’ শিরোনামে অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগঠনটি। এতে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে তা বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না।’
নানা তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না।’
সেলিম রায়হান বলেন, ‘নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্যকিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ।’
পণ্যমূল্য কেবল বাংলাদেশে বাড়ছে এমন নয়। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসার পর দেশে দেশেই এটি এক বড় সমস্যা হিসেবে ধরা দিয়েছে।
তবে সেলিম রায়হান মনে করেন, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করছে কি না সেটি দেখা উচিত। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। কারণ তারাও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। পণ্যের চাহিদা ও জোগান ঠিক রাখার বিকল্প নেই।’
সানেমের দৃষ্টিতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির যত কারণ
গবেষণা সংস্থাটি এ ক্ষেত্রে মোট সাতটি কারণ উল্লেখ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। এগুলো হলো ১. চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, ২. অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি, ৩. সরবরাহে ঘাটতি, ৪. পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার না থাকা এবং দুর্বল তদারকি ব্যবস্থা, ৫. আমদানি মূল্য, পরিবহন খচর ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময়হারের ঊর্ধ্বগতি, ৬. বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ৭. জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি।
নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের প্রধান অংশ খাদ্য কিনতে
সানেমের প্রতিবেদনে বলা হয়, শহরের পোশাক শ্রমিকদের একই পণ্য কিনতে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে। এই শ্রমিকরা যত ব্যয় করেন, তার ৬০ দশমিক ৫২ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে খাদ্য কিনতে।
দিন এনে দিন খায়- এমন শ্রমিকদের আয়ের ৬১ দশমিক ৫৯ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যপণ্য কিনতে। রিকশা ও ভ্যানওয়ালা শ্রেণির মানুষ খাদ্যপণ্য কিনেতে ব্যয় করেন আয়ের ৬০ দশমিক ৯১ শতাংশ। ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে এটি ৬১ দশমিক ৫১ শতাংশ।
গ্রামে ভূমিহীন কৃষকরা তাদের মোট আয়ের ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ খাদ্য কিনতে ব্যয় করে। দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই হার ৬৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গ্রাম এলাকার রিকশা শ্রমিক বা স্বল্প আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি কাছাকাছি রকমের।
মানুষের আয়ের প্রধান অংশ যখন খাদ্যের পেছনে খরচ হয়, তখন মানসম্মত আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনের পেছনে খরচে ঘাটতি পড়ে। পাশাপাশি অনিশ্চিত হয়ে যায় সঞ্চয়।
সানেমের চেয়ারম্যান বজলুল হক খন্দকারও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রশ্নের উত্তর দেন সংস্থার গবেষণা পরিচালক সায়মা হক বিদিশা।