পাশের দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বৈধভাবে লবণের ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন কক্সবাজারের সোনাদিয়ার জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম। এই বৈধ ব্যবসার আড়ালে তিনি মূলত করতেন মাদক কারবার।
৭ বছর ধরে জসিম নিয়মিত মিয়ানমার থেকে ইয়াবার চালান এনে বাংলাদেশে বিক্রি করছিলেন। গত এক বছর হলো ইয়াবার পাশাপাশি অবৈধ মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের কারবারও শুরু করেন তিনি। সে লক্ষ্যে জসিম গড়ে তোলেন নিজস্ব সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেটের হোতা জসিম উদ্দিন ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সেই সঙ্গে জব্দ করা হয়েছে সবচেয়ে বড় আইসের চালান।
জসিম উদ্দিন ছাড়া অন্য চারজন হলেন মকসুদ মিয়া, রিয়াজ উদ্দিন, শাহিন আলম ও সামছুল আলম।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে বুধবার রাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। ওই সময় অবৈধ মাদক আইসের (ক্রিস্টাল মেথ) ১২ কেজির চালান, ১ লাখ ইয়াবা বড়ি, ৪ হাজার ৬০০ চেতনানাশক ইনজেকশন, দুটি বিদেশি পিস্তল, ৯টি গুলি, দুটি টর্চলাইট, বার্মিজ সিম কার্ড, ১ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ও ১ লাখ বার্মিজ মুদ্রা এবং ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
ব্রিফিংয়ে কী জানাল র্যাব
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা মিয়ানমারের মাদক চক্রের যোগসাজশে দেশে অবৈধ আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত। জসিমের নেতৃত্বে এই মাদক সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দেশে এই চক্রের সদস্য সংখ্যা ১২ থেকে ১৫।
আল মঈন জানান, চক্রের সদস্যরা মূলত সোনাদিয়াকেন্দ্রিক মাদক চোরাকারবারি। ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশাল এলাকায় বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা অবৈধ মাদক ক্রিস্টাল আইস ও ইয়াবা সরবরাহ করেন তারা। নৌপথ ব্যবহার করে বিভিন্ন কৌশলে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে মাদক নিয়ে আসতেন চক্রের সদস্যরা।
র্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, জসিম উদ্দিন অনেক বছর ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে লবণের বৈধ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। বেশি মুনাফার লোভে তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যান। ৭ বছর ধরে তিনি মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত।
তিনি জানান, জসিম লবণ ব্যবসার আড়ালে প্রথমে ইয়াবা পাচার শুরু করেন। দেশে চাহিদা তৈরি হওয়ায় গত এক বছর হলো মাদক আইসের চালান আনা শুরু করেন তিনি।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাদক চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশের এই চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করে। সাগরপথে মাদকের চালান গ্রহণ ও নিরাপদস্থলে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা প্রায় ২০ থেকে ২৫ দিন জেলের ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে থাকেন। মালামাল গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসেন।
পরে ইয়াবা ও আইসের চালানগুলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপে জসিমের বিভিন্ন লবণের গুদামে লুকিয়ে রাখা হয়। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়াতে ক্রিস্টাল আইস ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসতেন। এভাবে বহনকৃত মাদকের চালান হাতিয়ায় পৌঁছালে চক্রটির হাতিয়ার সদস্যদের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষণ করা হয়।
র্যাবের ভাষ্য, চক্রের সদস্যরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়াসহ ঢাকার আশপাশে অথবা সুবিধাজনক স্থানে পৌঁছাতেন। ঢাকা ছাড়াও তারা বরিশাল, পটুয়াখালী অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতেন।
মাদকের চালান মুন্সিগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র আইস ও ইয়াবার চালান গ্রহণ করে এবং সড়কপথে বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। নৌপথে মাদক পরিবহনে তারা বিভিন্ন নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
র্যাবের কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য চক্রটি দুটি বোট ব্যবহার করে থাকে। সামনের বোটকে নজরদারি করতে ব্যবহার করা হতো। পেছনের বোটটিতে মাদক বহন করা হতো। মোবাইল অথবা টর্চলাইট সিগন্যালের মাধ্যমে উভয় বোটের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতেন।
পথে নজরদারিতে নিয়োজিত স্কর্ট বোট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেলে সামনের বোট থেকে পেছনের মাদকবাহী বোটকে সংকেত দিত। সংকেত পেয়ে মাদকবাহী বোটকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতেন চক্রের সদস্যরা। পরে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা মাদকের চালান নিয়ে রওনা দিতেন।
র্যাবের দাবি, গ্রেপ্তার শাহীন আলম জসিমের অন্যতম প্রধান সহযোগী। তিনি নৌপথে মাদক পরিবহনের মূল দায়িত্ব পালন করতেন। তার সঙ্গে সামসু ও মকসুদ মাদক বহন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতেন। আর রিয়াজ উদ্দিন মাদক পরিবহনে নজরদারির জন্য স্কর্ট বোট থেকে দায়িত্ব পালন করতেন।
বাহিনীটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, শাহীনের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মানব পাচার ও মারামারিসংক্রান্ত দুটি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার অপর সদস্য শামছুল আলমের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় অস্ত্র ও মারামারিসংক্রান্ত তিনটি মামলা রয়েছে। মকসুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতিসংক্রান্ত ছয়টি মামলা রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, অন্যান্য মাদকের সঙ্গে অবৈধভাবে চেতনানাশক সিডাকটিভ ইনজেকশন মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসত জসিমের সিন্ডিকেট। সেগুলো তারা দেশে ফার্মেসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করত। এসব প্রতিষ্ঠান ও ফার্মেসি সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছে র্যাব গোয়েন্দারা।