বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মা-মেয়েকে হত্যায় গ্রেপ্তার জুবায়ের কে?

  •    
  • ২ মার্চ, ২০২২ ২১:২১

জুবায়েরের বাবা আলাউদ্দিন মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে এলাকার কারও সঙ্গে চলাফেরা করত না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থাকত। শুধু নামাজের সময় ঘর থেকে বাইরে যেত। তবে বেশির ভাগ সময় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকত জুবায়ের। মোবাইলেও কথা বলত দরজা বন্ধ করে। এক-দেড় মাস ধরে সে কিছুটা উদ্ভট আচরণ করছিল।’

নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকার ডালপট্টি পাড়ায় মঙ্গলবার দুপুরে মা ও তার অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন আল জুবায়ের স্বপ্নীল নামে এক যুবক।

জুবায়েরের পরিবারের দাবি, বেশ কিছুদিন ধরেই ‘উদ্ভট’ আচরণ করছিলেন এই যুবক। ঝুঁকে পড়েছিলেন ধর্মের দিকে। পরিবারে আর্থিক অনটনের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও জুবায়েরের মা-বাবা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে তেমন কোনো সংকট নেই তাদের।

ডালপট্টি পাড়ায় মঙ্গলবার দুপুরে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে পাড়ার লোকজন একটি বহুতল ভবনের সামনে জড়ো হয়। দেখা যায়, ভবনের ভেতর থেকে বাসিন্দারা ছুটে বের হচ্ছেন। একপর্যায়ে কেউ একজন ভবনের ফটক বাইরে থেকে আটকে তালা লাগিয়ে দেন।

পরে পুলিশ গেলে জানা যায়, ওই ভবনের ষষ্ঠতলার ফ্ল্যাটে ঢুকে ৪৬ বছরের রুমা চক্রবর্তী ও তার অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে ২২ বছরের ঋতু চক্রবর্তীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে এক যুবক। বেঁচে গেছেন রুমার পুত্রবধূ ফারজানা আক্তার শিলা।

পুলিশ গিয়েই ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে হামলাকারী সন্দেহে ওই যুবককে আটক করে। তার দুই হাতে হ্যান্ড গ্লাভস ছিল। আটক ওই যুবকের নামই আল জুবায়ের স্বপ্নীল। ২৬ বছর বয়সী জুবায়েরের বাড়ি নগরীর পাইকপাড়া এলাকায়।

জুবায়েরকে আসামি করে বুধবার সদর থানায় মামলা করেন রুমার স্বামী রামপ্রসাদ চক্রবর্তী। আদালতের মাধ্যমে পুলিশ আসামিকে তিন দিনের রিমান্ডে পেয়েছে।

জুবায়েরের বিষয়ে জানতে বুধবার নগরীর পাইকপাড়া এলাকায় তার বাড়িতে যান নিউজবাংলার প্রতিবেদক। সেখানে কথা হয় তার বাবা আলাউদ্দিন মিয়ার সঙ্গে।

আলাউদ্দিন জানান, জুবায়ের তার একমাত্র সন্তান। মাইসদাইর এলাকার আদর্শ স্কুল থেকে ২০১১ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০১৩ সালে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন জুবায়ের।

আলাউদ্দিন জানান, তার ছেলে লেখাপড়া শেষ করেননি। পরে যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। বছর দুয়েক আগে করোনা মহামারিতে সেই চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকেই জুবায়ের বাসায় থাকতেন।

পাইকপাড়া এলাকার দোতলা বাড়িটি আলাউদ্দিনের নিজের। নিচে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তিনি থাকেন, দোতলায় ছোট্ট একটি রুমে থাকতেন জুবায়ের। বাড়ির সামনের অংশ দোকান হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে।

একসময় চট্টগ্রাম থেকে লবণ আনার ব্যবসা করতেন আলাউদ্দিন। বছর কয়েক আগে সেই ব্যবসা ছেড়ে দেন। দোকান ভাড়া ও জমানো টাকা দিয়েই তার সংসার চলে।

জুবায়েরের কক্ষ তল্লাশি করেছে পুলিশ

আলাউদ্দিনই নিউজবাংলার প্রতিবেদককে জুবায়েরের ঘরে নিয়ে যান। ছোট্ট কক্ষে আসবাব বলতে আছে একটি বিছানা ও একটি সোফা। ওই কক্ষের সঙ্গে লাগোয়া আরেকটি ছোট্ট কক্ষে আছে একটি আলমারি, টুল, প্লাস্টিকের ছোট র‍্যাক ও মেঝেতে বিছানো জায়নামাজ।

দুই কক্ষেই পুলিশ মঙ্গলবার তল্লাশি চালিয়েছে। এ কারণে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে পোশাক, নানা কাগজপত্র ও কিছু ইসলামিক বই।

আলাউদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে এলাকার কারও সঙ্গে চলাফেরা করত না। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থাকত। শুধু নামাজের সময় ঘর থেকে বাইরে যেত। তবে বেশির ভাগ সময় মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত থাকত জুবায়ের। মোবাইলেও কথা বলত দরজা বন্ধ করে। এক-দেড় মাস ধরে সে কিছুটা উদ্ভট আচরণ করছিল।’

‘উদ্ভট’ আচরণের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কথায় কথায় জুবায়ের রেগে যেত। প্রায়ই কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা দিত। আগে বাইরে মসজিদে নামাজ পড়তে যেত, তবে কয়েক দিন ধরে একেবারে ঘরবন্দি ছিল।’

জুবায়েরের মা শায়েলা শারমিনের সঙ্গেও কথা বলেছে নিউজবাংলা।

তিনি জানান, প্রতিদিন ফজর নামাজ পড়ে নাশতা খেয়েই তার ছেলে ঘরের দরজা লাগিয়ে দিতেন। মঙ্গলবারও তাই করেন। বেলা ২টার দিকে তিনি ছেলেকে দুপুরের খাবার খেতে ডাকতে গিয়ে দেখেন, ঘরে নেই জুবায়ের।

শায়েলা বলেন, ‘ বেলা সাড়ে ৩টার দিকে জানতে পারি আমার ছেলে খুন করেছে। রাত ৮টার দিকে বাড়িতে পুলিশ আসে। পরে তারা জুবায়েরের ঘর তল্লাশি করে ল্যাপটপ ও অনেকগুলো ইসলামিক বই নিয়ে গেছে।’

আগে কেমন ছিলেন জুবায়ের- এমন প্রশ্নের উত্তরে শায়েলা জানান, আগে স্বাভাবিক তরুণের মতোই আচরণ ছিল। বাইরে আড্ডা দিতেন, ঘুরতেন।

জুবায়েরের নামে হওয়া মামলায় মা-মেয়েকে হত্যা ও সোনার গয়না লুটপাটের অভিযোগ করা হয়েছে।

তবে আলাউদ্দিন জানান, করোনার সময়ে কিছুটা অভাব থাকলেও এখন তাদের কোনো আর্থিক সংকট নেই। সংসার সচ্ছলভাবেই চলছে। জুবায়ের যখনই হাত খরচ চাইতেন, তা দেয়া হতো।

তিনি বলেন, ‘সোনার গয়না-টাকার জন্য আমার ছেলে খুন করার কথা না। কেন এমন করল তা বুঝতে পারছি না।’

এলাকাবাসী যা বলছে

ওই বাড়ির সামনের ডেকোরেটর দোকানের মালিক আমান মিয়া বলেন, ‘ছেলেটা সব সময় ঘরের ভেতর থাকত। এলাকার কারও সঙ্গে চলাফেরা করত না। তবে কয়েক বছর আগেও স্বাভাবিক ছেলেদের মতো চলাফেরা করতে দেখেছি তাকে।’

এলাকার মুদি দোকানি মোসলেম মিয়া বলেন, ‘সব সময় পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে থাকত জুবায়ের। প্রায় দেখতাম মসজিদের দিকে যেতে। তবে তাদের বাড়িতে কাউকে যেতে দেখিনি কখনও। প্রয়োজনে দোকানে আসত, যা দরকার তা নিয়ে চলে যেত।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বলেন, ‘ওই ছেলে এলাকায় আমার চোখে পড়েনি কখনও। তাকে এলাকার মানুষও তেমন একটা চেনে না। এলাকায় পুলিশ আসার পর জানলাম সে আলাউদ্দিনের ছেলে। আর আলাউদ্দিনের পরিবার একটু ধার্মিক হওয়ায় তাদের বাড়িতে এলাকার মানুষের যাতায়াতও কম।’

যা বলছে পুলিশ

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (তদন্ত) আমির খশরু নিউজবাংলাকে জানান, জুবায়েরের কোনো জঙ্গিসংশ্লিষ্টতা আছে কি না তা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘আটক জুবায়েরকে নিহতদের পরিবারের কেউ চেনেন না বলে দাবি করেছেন। ঘটনার পর জুবায়েরের ব্যাগ থেকে নিহত ঋতুর স্বর্ণের চেইন উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে চারটি ছুরি ও কয়েকটি হ্যান্ড গ্লাভস।’

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জুবায়ের হত্যার কথা স্বীকার করেছেন।

থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিহত রুমার শরীরের ছয় জায়গায় ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তার মেয়ে ঋতুর শরীরের সামনে ও পেছনে তিনটি ছুরি ঢোকানো ছিল। আরও ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে।’

মামলার এজাহারের বাদী লিখেছেন, মঙ্গলবার তিনি ও তার ছেলে বাড়ির বাইরে ছিলেন। বেলা আড়াইটার দিকে তিনি খবর পান, তাদের ফ্ল্যাট যে ভবনে, সেটির নিচে অনেক লোক জড়ো হয়েছেন। তিনি গিয়ে দেখেন অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন বের হয়ে ভবনের ফটক বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখেছে। ভেতর থেকে তার ছেলে হৃদয়ের স্ত্রী ফারজানা আক্তার শিলা চিৎকার করছেন।

কী হয়েছে জানতে চাইলে শিলা বাদীকে জানান, তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে এক যুবক রুমা ও ঋতুকে ছুরি দিয়ে কুপিয়েছে। শিলাকে হত্যার জন্য রান্নাঘরের বঁটি হাতে নেয় হামলাকারী। তবে শিলা কৌশলে সেই বঁটি ছিনিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে নিচে নামেন। হামলাকারী যুবক তাকে ধাওয়া করে নিচে নামে, তবে ততক্ষণে ভবনের অন্য লোকজন টের পেয়ে বাইরে থেকে ফটক আটকে দেয়। ওই যুবক ফের ছয়তলার ফ্ল্যাটটিতে ফিরে যায়।

রামপ্রসাদ এজাহারে আরও লেখেন, শিলার কাছ থেকে শুনে তিনি স্ত্রী রুমার মোবাইল ফোনে কল করলে তা রিসিভ করেন ওই যুবক। টাকা-গয়না কোথায় আছে জানতে চান। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। ততক্ষণে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়। পুলিশসহ তিনি ফ্ল্যাটে গিয়ে ওই যুবককে আটক করেন। উদ্ধার করা হয় মরদেহ।

ঘটনাস্থলেই জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক নিজেকে জুবায়ের বলে পরিচয় দেন। তিনি জানান, প্রত্যেক ফ্ল্যাটের বেল বাজিয়েছিলেন। এই ফ্ল্যাটেরই দরজা খোলা হয়েছে।

রামপ্রসাদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মেয়ে ঋতু ৬ মাস ১৬ দিনের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। ওর স্বামীর বাড়ি চট্টগ্রামে। আমার স্ত্রী ও মেয়ের হত্যাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

এ বিভাগের আরো খবর