রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলেও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। চলতি বছরের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪২৯ কোটি ৪৫ লাখ (৪.২৯ বিলিয়ন) ডলার বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
বর্তমান বিনিময়হার (৮৬ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৩৭ হাজার টাকা কোটি টাকা।
গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ৩৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে শেষ হয়েছে। তারপরও ৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের আয়ে খুশি রপ্তানিকারকরা। এই আয় উল্লম্ফনের ইতিবাচক ধারারই ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই আয় তৃতীয় সর্বোচ্চ; সবচেয়ে বেশি এসেছিল গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৭ লাখ (৪.৯০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল আগের মাস জানুয়ারিতে ৪৮৫ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলার
শুধু তৈরি পোশাক নয়, প্রায় সব খাতেই রপ্তানি আয় বেড়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসের (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) হিসাবে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন (৩ হাজার ৩৮৪ কোটি ৩৪ লাখ) ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় প্রায় প্রতি বছরই বাড়ে। তবে লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারে কমই। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। করোনার মধ্যেও দারুণ প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি যতটা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে আয় করছে বাংলাদেশ।
আট মাসের রপ্তানি আয় এবার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি।
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের মোট ৮১ দশমিক ২৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। এ খাতে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এসেছে ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে। তার আগে থেকেই অবশ্য যুদ্ধের ডামাডোল চলছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের কয়েকটা দিন গেছে যুদ্ধের মধ্যে। এমনিতেই ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে; তারপরও যুদ্ধ শুরুর আতঙ্কের মধ্যে ভালো রপ্তানি আয় দেশে এসেছে বলে মনে করেন রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বেশ আতঙ্কের মধ্যে আছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক ছাড়াও কৃষি প্রক্রিয়াজাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রকৌশল পণ্য ও হস্তশিল্প রপ্তানি বেড়েছে। ফলে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে সাড়ে ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
যুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে উদ্বেগের সঞ্চার করেছে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির জন্য একটি সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান বাজার রাশিয়ার উপর বেশ কয়েকটি দেশ ব্যাপক পরিধিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশেষ করে সুইফট আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের বাণিজ্যে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
চেচেন প্রজাতন্ত্রের প্রধান রমজান কাদিরভ। ছবি: সংগৃহীত
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়ায় ৫৯ কোটি ৩০ লাখ ডলার পোশাক রপ্তানি করেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই (জুলাই-জানুয়ারি) রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি ডলারের পোশাক।
ফারুক হাসান বলেন, ‘বিজিএমইএ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা আমাদের সদস্যদের পরামর্শ দিয়েছি, তারা যেন রাশিয়ায় রপ্তানির জন্য যে ক্রেতাদের সাথে কাজ করছেন, তাদের তথ্যাদি, বকেয়া পেমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বিবরণ আমাদের কাছে পাঠায়। আমরা আমাদের সদস্য ও রপ্তানিকারকদের আরও পরামর্শ দিয়েছি যে, তারা যেন কালবিলম্ব না করে তাদের ক্রেতা ও লিয়েন ব্যাংকগুলোর সাথে যোগাযোগ করে এবং তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।’
বিজিএমইএ ইতোমধ্যেই বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রনালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কাছে তুলে ধরেছে বলে জানান তিনি।
‘বিষয়টির তীব্রতা বোঝা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার লক্ষ্যে সরকারও এরই মধ্যে বৈঠক ডেকেছে।’
পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩০.৭৩ শতাংশ
ইপিবির তথ্যে বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ২ হাজার ৭৫০ কোটি (২৭.৫০ বিলিয়ন) ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৭৩ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮১ দশমিক ২৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ৩২৭ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৩ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ৫০৭ কোটি ডলার। আয় বেড়েছে ৩১ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
এ ছাড়া জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৮৫ কোটি ৩২ লাখ ডলারের কৃষিপণ্য, ৯৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের হোম টেক্সটাইল, ৭৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ৮০ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪০ কোটি ৭১ লাখ ডলার। ওষুধ রপ্তানি থেকে এসেছে ১৩ কোটি ৬ লাখ ডলার।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি আয়ের মোট লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৪৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা আছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম।
২০২২ সালজুড়েই উল্লম্ফন থাকবে
যুদ্ধের প্রভাব খুব একটা না পড়লে ২০২২ সালজুড়েই রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফন অব্যাহত থাকবে বলে আশা কথা শুনিয়েছেন আরেক পোশাক রপ্তানিকারক নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা খুশি। এত দ্রুত করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে আমরা ঘুরে দাঁড়াব, ভাবতে পারিনি। করোনার ভয় এখন আর নেই। শঙ্কিত আমরা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। কেননা, রাশিয়াতেও এখন আমরা মোটামুখি ভালোই রপ্তানি করছি। এছাড়া এই যুদ্ধের প্রভাব ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারেও পড়তে পারে। তবে, আমার মনে হচ্ছে দুদেশের নীতিনির্ধারকরা যেহেতু আলোচনা বসেছেন। একটা ভালো-সম্মানজনক সমাধানে আসবেন। যুদ্ধ বন্ধ হবে। আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে। তাহলে আমাদের রপ্তাণি বাণিজ্যের বর্তমান ইতিবাচক ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা নতুন বছর শুরু করেছিলাম। সেটা অব্যাহত আছে। প্রচুর অর্ডার আছে; নতুন অর্ডার আসছে। দামও ভালো পাচ্ছি। যুদ্ধের প্রভাব খুব বেশি না পড়লে ২০২২ সালটা উল্লম্ফনের মধ্য দিয়েই যাবে বলে আমরা আশা করছি।’
অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে এখন রপ্তানি খাত। সত্যিই অবাক করার মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে এই খাতে। এই যে করোনার ধকল সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে রপ্তানি আয়।’
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট ৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।