৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি আজিজুল হক রানা আরেক আসামি মুফতি হান্নানের সঙ্গে বোমা তৈরি করতেন। তিনি বোমা তৈরিতে খুবই দক্ষ বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গিবিরোধী বিশেষ শাখা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি।
গতকাল মঙ্গলবার আজিজুল হক রানাকে রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর বুধবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানায় সিটিটিসি।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান আদর্শ কলেজের মাঠে ২০০০ সালের ২১ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশস্থলের পাশ থেকে ৭৬ কেজি ওজনের একটি বোমা উদ্ধার করা হয়। ওই মাঠেই পরদিন শেখ হাসিনার সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল।
এ ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপপরিদর্শক নূর হোসেন মামলা করেন।
এ ঘটনায় করা হত্যাচেষ্টা মামলায় ২০১৭ সালের ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-২-এর বিচারক মমতাজ বেগম ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও আসামিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
প্রায় ২১ বছর পর ২০২১ সালের ২৩ মার্চ এই মামলার রায় ঘোষণা হয় বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, রাষ্ট্রদ্রোহ ও হত্যা ষড়যন্ত্র মামলায়। এ মামলায় ১৪ আসামির সবার প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান।
আসামিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার কথা জানান বিচারক।
সমাবেশস্থল থেকে বোমা উদ্ধারের পর মামলার অন্যতম আসামি আজিজুল হক আত্মগোপনে চলে যান। তিনি দুই দশক ছিলেন আত্মগোপনে।
সিটিটিসি সংবাদ সম্মেলনে জানায়, সে সময় আজিজুল হক হরকাতুল জিহাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমও পরিচালনা করছিলেন।
সিটিটিসির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মামলাটিতে পাঁচজন পলাতক ছিলেন। যার একজন আজিজুল। তাকে আমরা ২১ বছর পর গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি চারজনকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফরসঙ্গীদের হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান সরকারী আদর্শ কলেজ মাঠে অবস্থিত সভামঞ্চের পাশে মাটির নিচে একটি ৪০ কেজি ওজনের বোমা এবং হেলিপ্যাডের (ডহর পাড়া) পাশে মাটির নিচে একটি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখে। সেই বোমা পুঁতে রাখার কাজটিতে সরাসরি যুক্ত ছিলেন আজিজুল।
আজিজুল হককে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সিটিটিসি প্রধান জানান, তিনি ১৯৮৭ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে জামিয়া আনোয়ারিয়া মাদ্রাসায় নূরানী বিভাগে ভর্তি হন। মাদ্রাসার ওস্তাদ ও হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্য মুফতি হান্নানের অনুসারী মাওলানা আমিরুল ইসলামের সংর্স্পশে আসেন। আমিরুল ইসলাম তাকে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন।
ওই মাদ্রাসায় মুফতি হান্নান, আব্দুর রউফ, আব্দুস সালামসহ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের সিনিয়র সদস্যদের যাতায়াত ছিল এবং হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) সদস্যরা ওই মাদ্রাসায় গোপন বৈঠক করতেন বলেও জানান তিনি।
আজিজুল হক হুজিবিতে যোগ দেয়ার পর সংগঠনের নেতা নেতা মুফতি ইজহারের চট্টগ্রামের লালখান মাদ্রাসায় গিয়ে বোমা তৈরি, আত্মরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়।
সিটিটিসি জানায়, সে সময় আমিরুল ইসলাম তাকে একটি চিঠি দিয়ে গোপালগঞ্জ বিসিক এলাকায় সোনার বাংলা সাবান ও মোমবাতি তৈরির কারখানায় পাঠান। সেখানে মুফতি হান্নানের সঙ্গে দেখা করে পরের সব পরিকল্পনা করেন।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, ‘আজিজুল হক নতুন নাম শাহনেওয়াজ পরিচয়ে ১৫ দিনের মতো মোমবাতি কারখানায় কাজ করেন। সেখানে থেকেই তিনি রাতে বোমা তৈরির কাজ করতেন। কাজটি করতেন আজিজুল হকসহ ইউসুফ ওরফে মোসহাব, মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ, ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক হোসেন, মহিবুল ওরফে মফিজুর রহমান, শেখ এনামুল হক, আনিসুল ইসলাম ওরফে আনিসসহ আরও কয়েকজন।’ জড়িত ছিলেন।
এতো বছর তিনি কীভাবে পালিয়ে ছিলেন, এটা কী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা কিনা জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এটা ব্যর্থতা নয়, সফলতা। ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেকে আত্মগোপনে রেখেছিলেন। তাকে ধরতে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে তদন্ত ও অভিযান পরিচালনা করে আসছিলাম।’
আজিজুল বিভিন্ন সময় টেইলারিং, মুদি দোকানদার, বই বিক্রেতা, ড্রাইভার এবং সবশেষ প্রিন্টিং ও স্ট্যাম্পপ্যাড বানানোর কাজ করেছেন ছদ্মবেশে। দেশ ছাড়তে চাইলেও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনে তিনি ধরা পড়ার ভয়ে সেটি করেননি বলে জানান সিটিটিসি প্রধান।
আজিজুল হক নতুন করে জঙ্গিদের সক্রিয় করছে কি না জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্তকর্তা বলেন, ‘তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি জানা যাবে। আমরা তাতে ১০ দিনের রিমান্ড চাইব।’
মামলটিতে এখনও লোকমান, ইউসুফ ওরফে মোছহাব মোড়ল, মোছহাব হাসান ওরফে রাশু, শেখ মো. এনামুল হক পলাতক আছেন।