দুর্নীতিসহ ১৩ অভিযোগ এনে দুর্নীতি দমন কমিশনের চাকরিচ্যুত উপপরিচালক শরীফ উদ্দিন চৌধুরী তার সাবেক কর্মস্থল দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে এসে তার বিরুদ্ধে আনা বেশ কিছু অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে।
মঙ্গলবার দুপুরে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, তিনি যদি অনেক বাড়ির মালিক হবেন, তাহলে সেগুলোর দখল যেন তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। তিনি যদি প্রভাব খাটিয়ে শাশুড়িকে গ্যাসের সংযোগ দিয়ে দেন, তাহলে সেটি কেন কাটা হচ্ছে না।
চাকরিচ্যুত হলেও শরীফের বিরুদ্ধে দুদকের তিনটি বিভাগীয় মামলা চলছে। সেগুলো নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তাকে ডাকা হয় দুদকে।
দুদক থেকে বের হয়ে এসে গণমাধ্যমকর্মীদের নানা প্রশ্নের এক ফাঁকে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি শরীফকে চাকরি থেকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এরপর দুদকের কর্মকর্তা থাকাকালে নানা আলোচিত দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগের বিষয়ে তার তদন্তের বিষয়টি সামনে আসে। তিনি প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় চাকরিচ্যুতির শিকার হয়েছেন- এমন অভিযোগ জোরালো হয়ে ওঠে।
দুর্নীতি ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ- টিআইবি এক বিবৃতিতে শরীফকে অপসারণের পেছনে কারণ জানতে চায়। বিএনপি অভিযোগ করে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় তাকে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি দুদক সচিব গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, শরীফের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। সেগুলো প্রকাশ্যে বলা হবে না। তবে এর তিন দিন পর দুদক সচিব পাঁচ পৃষ্ঠার একটি ব্যাখ্যা দিয়ে জানান, মোট ১৩টি অভিযোগে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সেই ব্যাখ্যায় শরীফের বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিযোগও আনা হয়।
শরীফ বলেন, ‘বলা হচ্ছে খুলশীতে আমার ৩৭টি বাড়ি আছে। আমার কথা হলো- আমার যা যা আছে, তাহলে তো তা অপরের দখলে। তা আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হোক।’
‘আমার শাশুড়ির গ্যাস লাইন কাটে না কেন?’
দুদক অভিযোগ এনেছে শরীফ প্রভাব খাটিয়ে তার শাশুড়ির নামে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি প্রভাব খাটিয়ে আমার শাশুড়ির বাড়িতে অবৈধ গ্যাস লাইন দিয়েছি। কোনটা আমার শাশুড়ির বাড়ি? আমি যদি অবৈধ লাইন দিয়ে থাকি, তাহলে তা বিচ্ছিন্ন করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন?’
তিনি বলেন, ‘অবৈধ লাইন পাওয়ায় আমি সানোয়ারা গ্রুপের লাইন বিচ্ছিন্ন করেছিলাম। আরও অনেকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি। আমার শাশুড়ির এমন লাইন থাকলে তা বিচ্ছিন্ন করা হোক।’
‘আমার ভাইয়ের চাকরি করার অধিকার নেই?’
দুদক বলেছে, শরীফ উদ্দিন ২০১৭ সালে কর্ণফুলী গ্যাসের বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর কেডিসিএল কর্তৃপক্ষকে তার আপন ছোট ভাই শিহাব উদ্দিন সবুজকে কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই ২০১৮ সালের ১ আগস্ট ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে চাকরি দেন। বর্তমানে আইটি ডিপার্টমেন্টে কর্মরত আছেন। এরপর ভাইয়ের চাকরি স্থায়ী বরতে সবাইকে চাপ দিচ্ছিলেন। তিনি সেখানে তার আত্মীয় মুহাম্মদ শাহাব উদ্দিনকে জাল সনদের মাধ্যমে ড্রাইভার পদে চাকরি দিয়েছেন। এ নিয়ে এখন তদন্ত চলছে।
এই অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে সরাসরি জবাব মেলেনি। শরীফ বলেন, ‘আমার ভাই একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করে। আউটসোর্সিংয়ে, নো ওয়ার্ক, নো মানি। সেই কোম্পানি হয়তো কোথাও ঠিকাদারির কাজ করে। এটা তো আমার ভাইয়ের দোষ না। আমার ভাইয়ের কি চাকরি করার অধিকার নেই?’
‘যারা রিট করেছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক নেই’
শরীফ উদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণের পক্ষে-বিপক্ষে আসা অভিযোগের তদন্ত চেয়ে ১০ আইনজীবীর রিট প্রসঙ্গেও কথা বলেন তিনি।
এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার হয়ে যারা কোর্টে রিট করেছেন, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের নামও কোনো দিন শুনিনি। এরা কেন, কোন উদ্দেশ্যে আমাকে বিবাদী করে উচ্চ আদালতে রিট করেছেন, আমি জানি না।
নথি বুঝিয়ে দিতে দেরি কেন?
দুদক অভিযোগ করেছে, পটুয়াখালীতে বদলির পর শরীফ যথাসময়ে নথি জমা দেননি। সংস্থাটি বলে, ‘কর্মস্থল ত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সব রেকর্ডপত্রসহ নথি যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেয়ার বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রাম কার্যালয়ে তার দায়িত্বে থাকা অনুসন্ধান ও তদন্তের নথি হস্তান্তর করেননি। প্রায় তিন মাস পর তাকে পটুয়াখালী থেকে ডেকে নিয়ে আসা হলে গত ২৯ আগস্ট তিনি নথি হস্তান্তর করেন। এই তিন মাস নথিগুলোর অনুসন্ধান বা তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে শরীফ বলেন, ‘আমার কাছে ১৩০টি নথি ছিল। মামলার আলামত ছিল পাঁচ আলমারি ভরা। এগুলো নিজে বুঝে চালান করে আরেকজনকে বুঝিয়ে দেয়া অনেক সময়সাপেক্ষ। তারপর আমি সেটা করেছি, হয়তো সময় লেগেছে। এরপর করোনা পরিস্থিতি ছিল।
‘করোনায় আমি নিজেও হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। সে কারণে আমার যোগ দিতেও দেরি হয়েছে, মামলার নথি বোঝাতেও সময় লেগেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেউ বদলি হলে ছুটি নিয়ে নথি বুঝে নেয়। আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। আমাকে ২০২১ সালের ২২ আগস্ট সরাসরি শোকজ করা হয়েছে। আমি কেন নথি হস্তাস্তর করিনি। অত্যস্ত দুঃখের বিষয়, আমাকে আসতেও দেয়া হয়নি, নথি হস্তান্তরের সুযোগও দেয়া হয়নি।’
‘প্রভাবিত হয়ে অবিচার করেছে কমিশন’
শরীফের অভিযোগ, তার ওপর অবিচার হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি তো মনে করি কমিশন কারও দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পর আমার ওপর অবিচার করেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৬ ফেব্রুয়ারি আমাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। দুঃখজনকভাবে হলেও সত্যি, আমি অপসারিত হওয়ার পরও বিভাগয়ী মামলায় হাজিরা দিচ্ছি। এটা আইনের দৃষ্টিতে কতটুকু সাম্য, তা আমি বলতে পারব না। তবে এটা নিয়ে আমি খুব বিব্রত।
শরীফ জানান, তার বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা চলমান। প্রথমটি হলো নো ডেবিট (ব্যাংক হিসাব স্থগিতের আদেশ), নথি হস্তান্তর দেরি কেন, আর তৃতীয় নম্বর ডিপি হলো আমি দেরিতে কর্মস্থলে যোগ দেয়ার কারণে।
‘প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রভাবশালীর রোষানলে’
এমন মন্তব্য করে শরীফ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ন্যায়বিচারের প্র্রতীক। তার কাছে খবর পৌঁছানোর কারণে আমি এখনও গুম হইনি। আমি আশা করি, তিনি আমার প্রতি ন্যায়বিচার করবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার সন্তানসহ পরিবার নিয়ে দুরবস্থায় আছি। আমার জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, নিশ্চয়তা নেই। প্রধানমন্ত্রী ও কমিশনের কাছে আমি কাজ করার সুযোগ চাই। আমি জীবন দিয়ে হলেও সুনাম রক্ষা করব।’