চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের জন্য ১০ দিন সময় দেয়া হলেও এর মধ্যে ৯ দিন অফিস ছিল বন্ধ। আবার অনলাইনে আবেদন ফরম পাওয়া যায়নি।
সময়মতো আবেদন করতে না পারার পর একজন প্রার্থী উচ্চ আদালতে রিট করেন। হাইকোর্ট তার আবেদনের শুনানি নিয়ে সেটি নিষ্পত্তি করতে বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সেটির বাস্তবায়ন হয়নি।
শিক্ষক নিয়োগে যে বোর্ড করা হয়েছে, তাতে কোনো ফার্সি বিশেষজ্ঞকে রাখা হয়নি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিধিতে যে বিষয়ে নিয়োগ, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ রাখার বিষয়টি উল্লেখ আছে।
আবার অনেক চাকরি প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, তারা ভাইভা কার্ড পাননি। বিশ্ববিদ্যালয় বলছে কার্ড ফেরত এসেছে, কিন্তু যাকে কার্ড পাঠানো হয়েছে বলা হচ্ছে, তার কাছে কোনো ফোনই যায়নি। আবার কার্ড না গেলেও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন একজন।
অভিযোগ উঠেছে, পছন্দের কোনো শিক্ষককে নিয়োগ দিতেই এত সব অনিয়ম করা হয়েছে।
তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি আর একজন প্রার্থী বিষয়টি নিয়ে আবার উচ্চ আদালতে গেছেন।
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
বিভাগের দুটি অস্থায়ী ও একটি স্থায়ী পদের বিপরীতে ২০১৯ সালের ১৬ মে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সে সময় উপাচার্য ছিলেন ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী। তার মেয়াদ শেষের ২৪ দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।
এতে আবেদনের সময় হিসেবে উল্লেখ করা হয় ২৬ মে পর্যন্ত। ফলে আবেদনের জন্য প্রার্থীরা সময় পান ১০ দিন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সময় ছিল এক দিনই।
১৭ ও ১৮ মে তারিখ ছিল শুক্র ও শনিবার, ১৯ থেকে ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এবং পরে আবার ২৪ ও ২৫ মে শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। কেবল ২৬ মে এক দিন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ছিল। আবেদনপত্র সংগ্রহের একমাত্র মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ১৬ মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর থেকে অকার্যকর ছিল বলে অভিযোগ আবেদনকারীদের। সরাসরি উপস্থিত হয়ে ফরম সংগ্রহ করার কোনো নির্দেশনা বিজ্ঞপ্তিতে ছিল না।এ কারণে একাধিক প্রার্থী আবেদন করতে ব্যর্থ হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফার্সি ভাষার খণ্ডকালীন শিক্ষক কামাল হোসাইন সার্বিক অসুবিধার বিষয়টি উল্লেখ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর ২৬ মে আবেদনের সময় বাড়ানোর জন্য চিঠি দেন। তবে এতে কোনো সাড়া দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।পরে উচ্চ আদালতে রিট করেন কামাল হোসাইন। শুনানি নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না মর্মে রুল জারি করে। সেই সঙ্গে আবেদনকারীর দরখাস্ত নিষ্পত্তির করতে নির্দেশও দেয়া হয়।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে আবেদনকারীর আবেদন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ রুলের পুরোপুরি নিষ্পত্তি না করেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে।কামাল হোসাইন এ বিষয় নিয়ে 'বিরক্ত’ উল্লেখ করে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।রিট নিষ্পত্তির বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রিটের জবাব বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছে। এতে রিটকারীর আবেদন গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে।’
বিশেষজ্ঞ ছাড়াই নিয়োগ বোর্ড
ফার্সি বিভাগে নিয়োগ দেয়া হলেও নিয়োগ বোর্ডে রাখা হয়নি ফার্সি বিশেষজ্ঞকে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বোর্ডে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সদস্য রাখতে হয়।প্রথম দফায় যে নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়, সেখানে সদস্য হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান বাহাউদ্দিন ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল হাসেম।আড়াই বছর আগে গঠিত নিয়োগ বোর্ডের মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় নতুন নিয়োগ বোর্ড গঠিত হয়। তিন সদস্যের এই বোর্ডে পদাধিকার বলে সদস্য হন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য শিরীণ আখতার। অন্য দুই সদস্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শামিম বানু ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মহীবুল আজিজ। এদের কেউই সরাসরি ফার্সি ভাষা সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক বা বিশেষজ্ঞ নন।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের তিন সদস্যের বোর্ড বসে।অভিযোগ এসেছে, ফার্সি বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি থেকে সিলেকশন বোর্ডের সদস্যের জন্য যে চারজনকে সুপারিশ করা হয়েছিল, তাদের একজনকেও রাখা হয়নি নিয়োগ বোর্ডে।নাম গোপন রেখে প্ল্যানিং কমিটির একজন সদস্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নিয়োগ বোর্ডে যাদের নাম ছিল তাদের কারও নাম আমরা প্রস্তাব করিনি। এদের কেউই ফার্সি বিশেষজ্ঞ নন।’নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ফার্সি বিশেষজ্ঞ না রাখার বিষয়কে 'হাস্যকর’ বলেন ফার্সি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল হাসেম। এ ঘটনায় তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।ফার্সি বিশেষজ্ঞ না রাখার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল হাসান বলেন, শামিম বানু অধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হলেও ফার্সি বিষয়ে তার ডিগ্রি আছে। তাকে ফার্সি বিশেষজ্ঞ হিসেবেই রাখা হয়েছে। মহীবুল আজিজকে ডিন হিসেবে রাখা হয়েছে।তিনি আরও বলেন, ‘সবাইকে তো আর রাখা যায় না। একজন যাকে এক্সপার্ট মনে করা হয়, তাকেই রাখা হয়। যাকে বিশেষজ্ঞ বলে মনে করা হয়েছে, তাকে নিয়োগ বোর্ডে রাখা হয়েছে।
ভাইভা কার্ড না পৌঁছানোয় পরীক্ষাবঞ্চিত, কার্ড না পেয়েও অংশগ্রহণঅভিযোগ মিলেছে, একাধিক প্রার্থীকে পাঠানো হয়নি ভাইভা কার্ড। ভাইভা কার্ড না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারেননি তারা। আবার ভাইভা কার্ড ছাড়াও পরীক্ষা দিয়েছেন অনেকজন। ভাইভা পরীক্ষা পুনরায় নেয়ার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেছেন আরও এক প্রার্থী।নাজমুন নাহার নামে এক প্রার্থী জানান, ভাইভা কার্ড না পাওয়া নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা। সরাসরি এসে তিনি রেজিস্ট্রার বরারব একটি লিখিত আবেদনও করেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার আবেদন গ্রহণ করেনি, তার অভিযোগ উল্টো তার সঙ্গে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ’ করেছেন। সর্বশেষ তিনি উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন।নাজমুন নাহার নিউজবাংলাকে বলেন, আমি ভাইভা কার্ড পাইনি। সে কারণে পরীক্ষাও দিতে পারিনি। আমাকে ফোন কিংবা এসএমএস করেও জানানো হয়নি। কোনোভাবে অবহিত করা হয়নি। পরীক্ষার জন্য আবেদন জানালে উল্টো আমার সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করা হয়েছে। এ জন্য আমি হাইকোর্টে রিট করেছি।তিনি বলেন, ‘যে বিষয়ে আমি বঞ্চিত হয়েছি, সে বিষয়ে আমি আবেদন জমা দিয়েছি। তারা (কর্তৃপক্ষ) আমার সঙ্গে সে বিষয়ে কথা বলবেন, সেটা না করে আমার ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে আমাকে অপমান করেছেন। আমার সঙ্গে আক্রমণাত্মক ব্যবহার করেছেন। এতে যে কেউ আহত হবেন এবং অপমান বোধ করবেন।’
নাহার বলেন, ‘আমি যখন গিয়েছি আমাকে রেজিস্ট্রার স্যারের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। আমি অনেক্ষণ অপেক্ষা করেছি। এরপর তিন দিন সময় নিয়ে স্যার (রেজিস্ট্রার) আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। সে সময় তার উত্তরে আমি সন্তুষ্ট হতে পারিনি।‘
সাহিদা আক্তার সনি নামে আরেক প্রার্থীও জানান ভাইভা কার্ড না পাওয়ার কথা। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আসলে আমার রিজিকে নেই, এটা আমার ব্যাড লাক। পরে এগুলো নিয়ে আমি আর কোনো মাতামাতি করিনি।’ভাইভা কার্ড না পেয়েও পরীক্ষা দেয়া এক প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তিনি বলেন, ‘আমি ভাইভা কার্ড পাইনি। আমরা একদিকে বঞ্চিত, অন্যদিকে লাঞ্ছিত। আমি কার্ড পাইনি, আমি একটা ফোন কলের মাধ্যমে ভাইভার বিষয়ে জানতে পারি, যে ফোনে আমার কাছে টাকাও চেয়েছিল। ভিসির পিএসও আমার কাছে টাকা চেয়েছে। কিন্তু আমি পড়ালেখা করা ছেলে, আমি টাকা দিতে আগ্রহী হইনি। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, তারা আমাকে কার্ড দেয়নি। ওরা যদি বলে যে চিঠি পাঠিয়েছি ব্যাক করে চলে আসছে, তাহলে সেই চিঠিতে আমার এলাকার পোস্ট অফিসের সিল ও সিগনেচার থাকবে।’ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার মনিরুল হাসান এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাইভা কার্ড সবাইকে পাঠানো হয়েছে। সেই প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। সব প্রার্থী ভাইভা কার্ড পেয়েছে।’নাজমুন নাহারের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাকে কোন তারিখে চিঠি পাঠানো হয়েছে, কোন তারিখে চিঠি রিজেক্ট হয়েছে সব ডুকমেন্ট আমরা তাকে দেখিয়েছি। তিনি আদালতে গেছেন, তিনি যে অভিযোগ করেছেন সেটা আসলে টিকবে না। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে আমরা চিঠি পাঠিয়েছি। আমাদের ডাকলে আমরা সেটি দেখাব।’