মো. ইয়াসিন আলী, রাজশাহী জেলার লালপুর মডেল কলেজ থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৯ সালের জুনে। এর পরের মাসেই প্রাপ্য অবসর ও কল্যাণ ভাতা পেতে আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনের পর প্রায় দুই বছরেও তিনি প্রাপ্য ভাতা পাননি।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বললেন ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় অবস্থিত ভালুকা ফাজিল মাদ্রাসা থেকে অবসর নেয়া শিক্ষক মাহতাব উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে অবসর নিয়েছি। এরপরই অবসর ভাতা ও কল্যাণ ভাতা পেতে আবেদন করেছি। কিন্তু এখনও কোনো ভাতাই পাইনি। অফিসে যোগাযোগ করলেই বলা হয়, এখনও আপনার সিরিয়াল আসেনি।’
সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরে গেলে ভবিষ্যৎ তহবিল ছাড়াও পেনশন ভাতা পাওয়ায় যে ভোগান্তি, তার অবসান হয়েছে অনেকটাই। অটোমেশন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এসব ভাতা পেতে সশরীরে এসে আবেদনও লাগে না।
কিন্তু উল্টো চিত্র বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাদের জন্য পেনশনের কোনো ব্যবস্থা নেই, ভবিষ্যৎ তহবিলের এই অর্থই তাদের সম্বল।
এই তহবিলে বেতনের একটি অংশ নিজেরা জমান শিক্ষকরা। সমপরিমাণ দেয় সরকার। কিন্তু চাকরি শেষে নিজের জমানো টাকা ফিরে পেতে বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে তাদের।
অথচ অবসরে যাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার আলাদা একটা বোর্ড করেছে। কিন্তু এর জন্য যে নিয়মিত বরাদ্দ রাখা দরকার, সেটিই করেনি। ফলে শিক্ষকদের জমানো টাকার বিপরীতে সরকারেরও যে সমপরিমাণ টাকা জমা দিতে হয়, তার ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি।
মাঝেমধ্যে সরকার থোক বরাদ্দ দেয়। এতে চাহিদার এক কোনাও পূরণ হয় না। ফলে অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের ভোগান্তি বছরের পর বছর বাড়ছেই।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের তথ্য বলছে, প্রতি মাসে অবসরকালীন সুবিধা চেয়ে আবেদন পড়ে গড়ে ৮০০টি। এমপিও থেকে প্রাপ্ত অর্থ বাদ দেয়ার পরও প্রতি মাসে ঘাটতি থাকে ৩০ কোটি টাকা। বছরে যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা।
এই ঘাটতি প্রতি বছর বাড়তে বাড়তে এখন তিন বছরের একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ২০১৯ সালে যারা অবসরে গেছেন, তাদের টাকাই এখনও দেয়া যাচ্ছে না। কেবল ওই বছরের মার্চ পর্যন্ত যাদের আবেদন জমা পড়েছে, তাদেরটাই পরিশোধ করা গেছে।
গত কয়েক বছরে বোর্ডের ব্যবস্থাপনায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেখানে শিক্ষকদের নিজের টাকা তোলার ক্ষেত্রে ঘুষ, দুর্নীতির যে অভিযোগ ছিল, তার অবসান হয়েছে অনেকটাই। পাশাপাশি কিডনি, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের মতো জটিল রোগের চিকিৎসা আটকে থাকলে সিরিয়াল এগিয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করা হয়।
তবে বোর্ডের সচিব শরীফ আহমেদ সাদী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিক্ষক-কর্মচারীদের দুর্ভোগ লাঘবে ইতোমধ্যে থোক বরাদ্দ হিসেবে ৮২২ কোটি টাকা দিয়েছেন। ফলে যেখানে ৫-৬ বছরের জট ছিল তা কমে আড়াই/তিন বছরে এসেছে। আমাদের টার্গেট এ জট একদম শূন্যে নামিয়ে আনা। এ ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।’
এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে থোকের বদলে বাজেটে একটি নির্দিষ্ট বরাদ্দ দেয়ার পক্ষে শরীফ সাদী। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
একই অবস্থা কল্যাণ ট্রাস্টেও। আবেদন বিবেচনায় প্রতি মাসে কল্যাণ ট্রাস্টে চাহিদা প্রায় ৬০ কোটি টাকা। কিন্তু বিভিন্ন উৎস থেকে আয় হয় ৪১ কোটি টাকা। মাসে ঘাটতি থাকে ১৯ কোটি টাকা। বছরে ঘাটতি দাঁড়ায় ২২৮ কোটি টাকা। এখানেও ঘাটতি বাড়লে সরকার থোক বরাদ্দ দেয়। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়নি।
জানতে চাইলে কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘সবাইকে প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ করতে আমাদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দুটি উৎস থেকে অর্থ পেয়ে থাকি। এর মধ্যে একটি এমপিও খাত থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের দেয়া চাঁদা এবং স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ। কিন্তু এ আয়ের তুলনায় ব্যয়ের চাহিদা অনেক বেশি। এ জন্যই শিক্ষকদের অর্থ পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
সব মিলিয়ে এখনও ৫১ হাজার শিক্ষক তাদের টাকার অপেক্ষায়। এর মধ্যে ৩২ হাজার জন অবসর বোর্ডে এবং ১৯ হাজার জনকল্যাণ ট্রাস্টে। তাদের টাকা পেতে আড়াই থেকে তিন বছর লেগে যেতে পারে।
কেন এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না, জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘তহবিল সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। শিগগিরই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
দেশে এ পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়েছে এমন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ।
২০০২ সালে বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা দেয়া শুরু হয়। আইন অনুযায়ী শিক্ষকরা প্রতি মাসে এমপিও বা বেতন থেকে চাঁদা দেবেন। শুরুতে যা ছিল ৪ শতাংশ। এখন তা ৬ শতাংশ করা হয়েছে।