মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র সংলাপ 'ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্রপল্লিতে- এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।' এর মতোই পদ্মাপাড়ের মৎস্যজীবীদের অবস্থা।
তাদের আক্ষেপের সুর এতটাই করুণ যে তারা মনে করে তাদের বেঁচে থাকাটাও এখন অভিশাপ। ঈশ্বরের আশির্বাদ কিংবা সরকার অথবা জনপ্রতিনিধিদের কৃপাদৃষ্টি কোনোটিই যেন তাদের জন্য না।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের আক্কাস, মজিদ, মতিন, দিনমণি সবার জীবনেরই যেন একই চিত্র। সবাই সবার জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লড়াই করছেন অনবরত। বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য তাদের একমাত্র সম্বল তাদের মনবল।
ঘরে থাকা ছেলেমেয়ে, বউ বা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড়ে নিরলস কাজ করে যাওয়া। পদ্মার বুকে ভেসে বেড়ানো। কিন্তু যে পদ্মা একসময় এসব পরিবারের জন্য ছিল আশির্বাদ, অন্নদাতা সে পদ্মাও এখন কেমন যেন কৃপণ হয়ে গেছে।
পদ্মাও এখন তাদের অন্নের জোগানদাতা হতে চায় না। এই দোষ তারা পদ্মাকে কখনও দেয় না। তাদের দোষারোপটা প্রকৃতিকেও না। মূলত বলতে গেলে তাদের কোনো দোষারোপ নেই কারো প্রতি, আছে শুধু আক্ষেপ। তবে এসব মৎস্যজীবীর আক্ষেপের কারণ তারাই, তাদের জন্যই পদ্মাও এখন কৃপাদৃষ্টি এসব মৎস্যজীবীর ওপর থেকে তুলে নিয়েছে, সেসব মানুষের নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ।
ছেঁড়া-ফাটা জালে তালি দিয়ে মাছ ধরতে যেতে হয় এখানকার মৎসজীবীদের। ছবি: নিউজবাংলা
মজিদ মণ্ডল বলছিলেন, ‘আমাদের বাপ-দাদারা এই পদ্মায় মাছ ধরেই সংসার চালাইছে। আমরাও সেই কাজই করতে আইছি। কিন্তু পদ্মায় আর আগের মতন মাছ পাওয়া যায় না। চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল- এসবের কারণে পদ্মার মাছ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। চায়না দুয়ারিতে যে মাছই ধরা পড়ে, সে মাছই মইরে যায়। যার কারণে মাছ ছোট থাকতেই মরে যাচ্ছে। বড় মাছ পাওয়াও যাচ্ছে না।’এ সময় আক্ষেপ করে আরও বলেন, প্রশাসন অভিযান চালায় ঠিকই, কিন্তু এসব কারেন্ট জাল বা চায়না দুয়ারী জাল দিয়ে যারা মাছ ধরে তাদের ধরতে পারে না। আপনারা সাংবাদিক, আপনারা ক্যামেরা নিয়ে যান ওদের কাছে।
‘দেখবেন পলাইয়ে গেছে। আর এদিকে প্রশাসনের লোকজন এসে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। আমাদের জাল নষ্ট করে ফেলে। আমাদের জালে তো আর ছোট মাছ মারা যায় না। আমরা সুদে টাকা নিয়ে জাল তৈরি করি। সেই জাল নষ্ট করে দিলে আমাদের মরা ছাড়া উপায় থাকে না।’আক্কাস আলী বলেন, ‘বছরের ছয় মাসই মাছ ধরা বন্ধ থাকে। রেশনে ৮০ কেজি চাউল দেয়। সেই ৮০ কেজি চাউলে ৬ মাসে কেমনে চলে? তার মধ্যে আবার দেখা যায়, যারা আসল জেলে তারা কার্ড পায় না। কার্ড পায় চায়ের দোকানদার, রিকশাওয়ালারা।
‘আমাদের বাইচে থাকাটাও এখন অভিশাপের মতন। আমাদের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। আপনাদের কাছে কথা বইলেও লাভ নাই ভাই। আপনারাও আমাদের জন্য কিছু করতে পারবেন না।’মজিদ মণ্ডল নামের আরেকজন বলেন, ‘আজ থেকে ১৫ বছর আগেও যেরকম মাছ পাইতাম, সে রকম মাছ আর পাওয়া যায় না। আমাদের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। সব মিলিয়ে আমরা দায়-দেনায় ডুবে আছি। এখন তো আমাদের খাইয়ে-পরে বাঁইচে থাকাই কঠিন।’দিনমণি জাল বুনতে বুনতে গল্পে জানান, তার সংসারে ৬ জন মানুষ। তার বাবা ঠাকুরদার আমল থেকে তারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এই পদ্মা তাদের মা। পদ্মার বুকে জাল ফেলেই খাবারের জোগানো হয়।
তিনি বলেন, দেখেন এখন আর মাছ পাই না তেমন। জালটাও ছিঁড়ে গেছে। নতুন জাল নেওয়ার টাকা নাই। আগেরও দেনা আছে। নতুন করে ঋণ নিতে পারতেছি না। তাই ছেঁড়া জালেই তালি দিয়ে মাছ ধরতে যেতে হবে।’
বেলা বাড়ে, তাদের জালে ছেঁড়া-ফাটা ঠিক হয়। তারাও দলবেঁধে কয়েকটা নৌকায় পাড়ি জমায় পদ্মার বুকে আগামীকালটা ভালো যাওয়ার আশায়।রাজবাড়ী জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘পদ্মার মাছ সংকটে আমরাও চিন্তিত। এই বিষয়ে আমরা গবেষণা চালাচ্ছি। যারা মৎস্যজীবী না কিন্তু নিবন্ধিত এমন খুঁজে বের করা হচ্ছে। তাদের নিবন্ধন বাতিল করে আসল মৎস্যজীবীদের নিবন্ধন করা হচ্ছে। মাঠপর্যায়ে কাজ চলমান।
‘এ ছাড়া মৎস্যজীবীদের অন্যপেশায় স্বাবলম্বী করতে আমরা প্রাথমিকভাবে একটি প্রকল্প গ্রহণ করছি। এর আওতায় তাদের হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল ও সেলাই মেশিন দেয়া হবে।’
কারেন্ট জালের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কারেন্ট জাল, নেট জাল বা চায়না দুয়ারি রোধে আমাদের কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। একই সঙ্গে জাটকা আহরণ, বিপণন, পরিবহন রোধের ক্ষেত্রেও আমাদের দৃষ্টি রয়েছে।’