সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনে উজির মিয়ার মৃত্যুর অভিযোগের বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহলের নজরে আনা হবে বলে জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।
তিনি বলেন, ‘সরকার এমন ঘটনা পছন্দ করে না। যদি বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমি এটা সরকারের খুব উচ্চপর্যায়ের নজরে নিয়ে আসব। আর কোনো উসকানি থেকে আপনারা দূরে থাকবেন।
‘আমি বলে গেলাম, যদি আমার কথা না মেলে তাহলে আপনারা আসবেন আমার কাছে। আমি ওই দুই রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করব। তারপর বড় রিপোর্ট দরকার পড়লে এ ঘটনা আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজরে নিয়ে আসব।’
শান্তিগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন গ্রামে উজির মিয়ার বাড়িতে গিয়ে শুক্রবার তার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেন মন্ত্রী। এরপর তিনি এসব কথা বলেন।
যেকোনো ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া অনুযায়ী করতে হয় জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘বিচারে একটু সময় লাগে, প্রমাণ লাগে। প্রক্রিয়ামতে বিচার করতে হয়। আমরা হাতেনাতে মুখে-মুখে বিচার করে ফেলি। কোনো কোর্টও এ রকম বিচার করতে পারে না। এটি যদি না মানেন তাহলে সমস্যা হবে।’
উজির মিয়ার স্বজনদের ও উপস্থিত সবাইকে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি- সঠিক প্রক্রিয়ায় বিচার যেন হয়, আমি যতটুকু সম্ভব এটি দেখব। সেখানে কোনো ছাড় দেব না। এ সরকার চায় না অন্যায়ভাবে কোনো নাগরিক নির্যাতনের শিকার হোক... কোনো মহলের বাড়াবাড়ি হয়ে থাকলে এটিরও বিচার আছে। একটু ধৈর্য ধরতে হবে এবং তদন্ত রিপোর্টগুলো আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’
উজির মিয়ার বাড়িতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান
মন্ত্রী বলেন, ‘মিডিয়ার লোকজন রয়েছেন, তারাও বিষয়টি দেখছেন। এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখানে যে কেউ হোক, পুলিশ হোক, অফিসার হোক, যদি সে বাড়াবাড়ি করে তাহলে আইন আছে। সেই আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। সে জন্য নতুন আইন বানানোর প্রয়োজন নেই।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামীকাল ডিসি এবং এসপির সঙ্গে আমার দেখা হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলব। যত দ্রুত সম্ভব ঘটনার শেষ দেখতে চাই।’
ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
গত ১৩ জানুয়ারি গোচারণ ভূমি থেকে আমরিয়া গ্রামের নুর উদ্দিনের একটি গরু হারায়। পরে খবর আসে যে পাশের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার এক বাজারে গরু ও অটোরিকশাসহ চারজনকে আটক করে স্থানীয়রা।
শান্তিগঞ্জ (দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) থানার এসআই দেবাশীষসহ কয়েকজন পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান নুর উদ্দিন। সেখান থেকে গরু ও অটোরিকশা উদ্ধার এবং চারজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।
পরদিন এই চারজনসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে থানায় গরু চুরির মামলা করেন নুর উদ্দিন। মামলার আসামিরা হলেন আমরিয়া গ্রামের মোস্তাকিম মিয়া, ছাদিকুর রহমান, সালমান হোসেন ও আব্দুল মোতালিব।
আপসে নিষ্পত্তি
নুর উদ্দিন থানায় যখন মামলা করেন, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন একই এলাকার মতচ্ছির আলী। মামলার চার নম্বর সাক্ষী তিনি।
বৃহস্পতিবার তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নুর উদ্দিন মামলা করতে চাননি। কিন্তু পুলিশ জানায়, উদ্ধার করা গরু আদালতের মাধ্যমে ছাড়িয়ে নিতে হবে। তাই একটি লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। এ কথা শুনে লিখিত অভিযোগ দেয় নুর উদ্দিন।’
গরু চুরি মামলার বাদী ও চার আসামির বাড়ি উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নে। এই ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গরু আটকের পর পরই সেখান থেকে একজন ইউপি সদস্য আমারে কল দেন। আমি নুর উদ্দিনকে খবরটি জানাই এবং সেখানে যেতে বলি। এরপর জানতে পারি- এই ঘটনায় যাদের আটক ও মামলায় আসামি করা হয়েছে তারা সবাই আমার এলাকার। আসামিপক্ষের লোকজনও আমার কাছে এসে বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন।
‘তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আমি নুর উদ্দিনকে আপসের প্রস্তাব দিই। তাকে বলি, আসামিরা আর এই কাজ করবে না বলে কথা দিয়েছে। ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওই রাতেই নুর উদ্দিন থানায়ও আপসের কথা জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিনই সব আসামি আদালতের মাধ্যমে জামিন পান।’
এরপর গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমেও বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তি হয়েছিল বলে জানান নুর উদ্দিনের মামলার সাক্ষী মতচ্ছির আলী। তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার কিছুদিন পরই গ্রামে সালিশ বৈঠক বসে। ঠিক কবে সালিশ বসেছিল তা এখন মনে নেই। তবে মাসখাসেক আগে তো হবেই। সালিশে আমিও ছিলাম। ওই দিনই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়।’
উজির মিয়া কেন গ্রেপ্তার
ঘটনা ঘটে শান্তিগঞ্জের দরগাপাশা ইউনিয়নে। গরুর মালিক ও আটক চারজন একই এলাকার। অথচ ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে পাশের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্ধন গ্রামের উজির মিয়াকে আটক করে পুলিশ। কেন এই মামলায় উজিরকে আটক করা হয়, সে জবাব নেই স্থানীয়দের কাছেও।
উজির মিয়ার শরীরে আঘাতের চিহ্ন
মামলার সাক্ষী মতচ্ছির আলী বলেন, ‘গরু উদ্ধার, মামলা, সালিশ বৈঠক- সব সময়ই আমি উপস্থিত ছিলাম। এই ঘটনায় উজির মিয়ার সম্পৃক্ততার কথা কেউ কখনও বলেননি। বাদীও তার নাম বলেননি। তবু তাকে কেন আটক করা হলো, তা পুলিশই ভালো বলতে পারবে।’
আপসের পরও উজিরকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে বৃহস্পতিবার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মুক্তাদির হোসেন দাবি করেন, তিনি কিছু জানেন না।
নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গরু চুরির মামলায় কোনো আপস হয়েছে কি না তা আমার নলেজে নেই। তখন আমি ছুটিতে ছিলাম। আর এই ঘটনায় এখন উচ্চপর্যায়ের তদন্ত চলছে। ফলে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
উজির মিয়ার পরিবারের অভিযোগ
৯ ফেব্রুয়ারি রাতে সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্ধন গ্রামের যুবক উজির মিয়াকে বাড়ি থেকেই মারতে মারতে পুলিশ থানায় নিয়ে যায় বলে অভিযোগ পরিবারের।
পরে উজির মিয়াকে থানায় নিয়েও ব্যাপক নির্যাতন করা হয় বলে জানান তারা। পরদিন তাকেসহ চারজনকে গরু চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। ওই দিনই আদালত থেকে উজির মিয়াসহ তিনজন জামিনে ছাড়া পান। শামীম মিয়া নামে একজনকে কারাগারে পাঠায় আদালত।
জামিন পেয়ে বাড়ি ফেরার পর উজির মিয়ার সারা শরীরে পিটুনির চিহ্ন ছিল, তার দুই হাত কাঁপছিল। ছবি: ভিডিও থেকে নেয়া
পরিবারের সদস্যরা জানান, জামিন পাওয়ার পর উজিরকে বাড়িতে আনা হয়। তখন তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি দাঁড়াতে ও কথা বলতে পারছিলেন না। এরপর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সেখানে দুই দিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে তাকে আবার বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। গত সোমবার সকালে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্থানীয় কৈতক হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। থানা পুলিশ মামলা না নিলে তারা আদালতে যাবেন।