মাস্টার্স পড়ুয়া সাজু মিয়া পেশায় পাঠাওচালক। মোটরসাইকেলের সমস্যা সমাধানে দক্ষিণখান এলাকার একটি মেকানিকের দোকানে যেতেন। সেই দোকানের মেকানিকের মাধ্যমে পরিচয় হয় কথিত বিজিবি সদস্য সামসুজ্জোহা ওরফে জুয়েলের সঙ্গে।
বিজিবি থেকে প্রেষণে র্যাবে কাজ করছেন জানিয়ে সাজুকে চাকরির প্রলোভন দেখান জুলেল। বিশ্বাস অর্জনের জন্য সাজুর সঙ্গে চক্রের অন্য সদস্যদের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন জুয়েল।
এভাবে আস্থা অর্জন করে ভুয়া চাকরির নিয়োগপত্র দিয়ে সাজুর কাছ থেকে সাড়ে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন জুয়েল।
সাজু বলেন, ‘একটা চাকরির আশায় বাড়ি, ঘর, জমি ও গোয়ালের গরু বিক্রি করে জুয়েলকে টাকা দিয়েছি কিন্তু সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’
রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে সেনাবাহিনী ও বিজিবিতে চাকরির প্রলোভনে অর্ধশত মানুষের কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বুধবার রাত ১১টার দিকে র্যাব-১-এর একটি দল তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন সামসুজ্জোহা ওরফে জুয়েল, শামীম হাসান তালুকদার ও আলমগীর হোসেন।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বৃহস্পতিবার বিকেলে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন।
তিনি জানান, গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর একটি ভুয়া পরিচয়পত্র, দুটি ভুয়া বিজিবির পরিচয়পত্র, তিনটি ভুয়া নিয়োগপত্র, ১৬ পাতা ব্যাংক স্টেটমেন্ট, একটি ব্যাংক চেক ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ছয়টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
যেভাবে পাতা হতো ফাঁদ
র্যাব-১ অধিনায়ক বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে সামসুজ্জোহা ও জুয়েল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চাকরিপ্রত্যাশী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কৌশলে পরিচিত হতেন। পরিচয়ের সূত্র ধরে আসামি তার পরিচিত কয়েকজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার মাধ্যমে সেনাবাহিনী ও বিজিবিতে চাকরি দিতে পারবেন বলে জানান।
‘একপর্যায়ে সেনাবাহিনী, বিজিবিতে অফিস সহকারী, বাবুর্চি, কেরানি, মেসওয়েটারসহ বিভিন্ন বেসামরিক পদে চাকরির জন্য পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা নেন তারা। এরপর চাকরিপ্রার্থীদের মেডিক্যাল চেকআপের কথা বলে সেনা কর্মকর্তার পিএ পরিচয় দেয়া আলমগীর হোসেনের মাধ্যমে চক্রের অপর সদস্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা (লেফটেন্যান্ট কর্নেল) পরিচয় দেয়া শামীম হাসান তালুকদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে ঢাকা সেনানিবাসের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যেতেন।’
আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, ‘সেনাবাহিনী এলাকায় যাওয়ায় চাকরিপ্রার্থীরা বিশ্বাস করতেন। পরে ওই চক্রের সদস্যরা ভুয়া নিয়োগপত্র দেন। সেখানে সেনাবাহিনী, বিজিবির মনোগ্রাম যুক্ত বেসামরিক পদে চাকরির নিয়োগপত্র শিরোনাম লেখা। তবে এই নিয়োগপত্র নিয়ে সেনানিবাসে গেলে ভুক্তভোগীদের বলা হতো এটা ভুয়া নিয়োগপত্র।’
চক্রের সদস্যদের বিষয়ে যা জানাল র্যাব
গ্রেপ্তার চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে আব্দুল্লাহ মোমেন বলেন, ‘সামসুজ্জোহা ওরফে জুয়েল এই চক্রের হোতা। জুয়েলের নামে অস্ত্র আইন, নারী নির্যাতন, প্রতারণা ও মাদকসহ দেশের বিভিন্ন থানায় আটটি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে তিনটিতে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
‘২০১৫ সালের দিকে চক্রের অপর দুই সদস্য আলমগীর ও শামীমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারা দুজনেই কম্পিউটার প্রিন্ট, ফটোকপি দোকানের মালিক। তাদের দোকানে অনলাইনে চাকরির জন্য আবেদন করতে আসা ব্যক্তিদের মাধ্যমেই বিভিন্ন বাহিনী ও সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির তথ্য সংগ্রহ করত। সেখান থেকে প্রাপ্ত চাকরিপ্রার্থীদেরকেই তারা প্রাথমিকভাবে টার্গেট করতেন।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘শামসুজ্জোহা ওরফে জুয়েল শুরু থেকেই নিজেকে বিজিবির সদস্য হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। এই চক্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের লোকজনকে বাহিনীতে চাকরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করে আসছিলেন।’
এক প্রশ্নের উত্তরে র্যাব-১ অধিনায়ক বলেন, ‘চক্রটি অর্ধশত মানুষের কাছ থেকে ২ কোটির বেশি টাকা আত্মসাৎ করেছে। দেশের উত্তর অঞ্চলের, বিশেষ করে লালমনিরহাটের অনেক ভুক্তভোগী পেয়েছি। এই চক্রে তারা তিনজনই সদস্য।’