সারি সারি পুরোনো বোতল। কোনোটি তেলের, কোনোটি মবিলের। আছে পাউডার বা অন্য কোনো কসমেটিক্সের কৌটাও। কিছু আবার নারকেলের খোসা। কিছু প্লাস্টিকের ভাঙা আসবাব।
পরিত্যক্ত এসব পাত্রেই উঁকি দিচ্ছে নতুন প্রাণ, ফুটছে ফুল। অর্কিড থেকে ঔষধি। যার হাতের ছোঁয়ায় এমন প্রাণের স্পন্দন, তিনি মিজানুর রহমান সাগর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাউন্ডারি-সংলগ্ন এলাকায় গড়েছেন নিজের নার্সারি।
সাগরের মতে, পরিত্যক্ত পাত্রে কম খরচেই ফুল ফুটে আবার পরিবেশের জন্যও তা কাজের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের পাশেই সাগরের নার্সারি। সারি সারি কোমল পানীয়র বোতল, তেলের বোতল, পানির বোতল, মদের বোতল এমনকি ভাঙ্গারি মগ, ক্যান, বালতি, ডাবের খোসা সবকিছুতেই আছে গাছ। এগুলোর দামও বেশি নয়।
নার্সারিটিতে গাছের সর্বোচ্চ দাম ১৫০ টাকা, সর্বনিম্ন ২০। মূলত ফেলে দেয়া বর্জ্যের কারণেই দাম কিছুটা কম। টবে যে গাছ বিক্রি হয় ৫০ থেকে ৬০ বা ১০০ টাকায়, সেগুলোই সাগরের নার্সারিতে মিলছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়।
গাছের পরিচর্যায় সাগর। ছবি:নিউজবাংলা
এগুলো রাখতে জায়গাও লাগে কম। অনেকে বারান্দায় গ্রিলের মধ্যেই বেঁধে রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সস্তায় গাছ নিয়ে যান বাসায় কিংবা মেসে। অল্প পরিসরে রাখার সুযোগ পান তারা।
সাগরের বাড়ি নগরীর উপকণ্ঠে কাটাখালি পৌরসভার সমসাদিয়াপুর এলাকায়। তার বাড়িতে দুই ছেলেমেয়ে, স্ত্রী ও মা আছেন। মূলত গাছের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তিনি এই পেশায় আছেন। নার্সারিই তার একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম।
সাগর বলেন, ‘নার্সারিতে পানির ব্যবস্থা করতে না পারায় প্রতিদিনই আমি পানি নিয়ে আসি কিছুটা দূর থেকে সাইকেলে করে। গাছের সঙ্গে থেকে থেকে আমার এটি অভ্যাস হয়ে গেছে।’
১৯৯৫ সাল থেকে এই কাজ করছেন সাগর। তার নার্সারিতে এখন ২৫০ প্রজাতির ২২০০ গাছ আছে। এগুলোর মধ্যে ঔষধি, অর্কিড, ক্যাকটাস, ফুল ও ফলের গাছই বেশি।
তিনি বলেন, ‘আমি এসব বোতল ভাঙ্গারির দোকান থেকে কিনে আনি। ৩০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। এরপর এগুলোকে বিভিন্ন স্টাইলে কেটে গাছ রোপণ করি। যেসব পাতাবাহার পানিতে হয় সেগুলোকে পানিভর্তি বোতল কিংবা কৌটায় রেখে দেই। মূলত ছোট পাত্রে দেখতে সুন্দর, কম দাম হওয়ার কারণে এগুলোর চাহিদা বেশি। গড়ে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি।’
সারি সারি পুরোনো বোতলে হরেক গাছের বাহার। ছবি:নিউজবাংলা
সাগর জানান, শুরুটা ছিল শখের। পরে দেখলেন এটিকে ব্যবসা হিসেবে নিলে মন্দ হয় না। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালের পাশে নার্সারি করেন তিনি। এর জন্য কোনো ভাড়া দিতে হয় না বলে ব্যবসার খরচও কম।
গাছের পরিচর্যা থেকে বিক্রি সব কিছু নিজেই করেন সাগর। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একই সঙ্গে চলে পরিচর্যা আর বিক্রি। যেসব পাতাবাহার ডাল থেকে গাছ হয় সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রতিনিয়তই গাছের সংখ্যা বাড়ছে।
ফুলের গাছ কিনতে আসা মাইনুল ইসলাম জানান, তিনি এর আগেও সাগরের নার্সারি থেকে গাছ নিয়ে গেছেন। বড় নার্সারিগুলোর তুলনায় এখানে দাম কম। আবার ভাঙা বোতল বা কৌটার কারণে জায়গাও কম লাগে। চাইলে এগুলোকে টবেও স্থানান্তর সম্ভব।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাইমা সুলতানা থাকেন বিনোদপুর এলাকার ছাত্রীনিবাসে। গাছ কিনতে এসে তিনি বলেন, ‘বান্ধবীদের কাছে এই নার্সারির নাম শুনেছি। গোলাপের চারা নিতে এসেছি। আমি যতটা শুনেছি, এসে দেখছি এখানে গাছের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।’
সাগর জানান, এখানে নার্সারি করার কারণেই তিনি খুব পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাকে ভালোবাসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়ির নষ্ট কৌটা বা বোতল যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে নিজের বাড়িতেও এভাবে গাছ লাগাতে পারি। তাহলে পরিবেশের জন্য এগুলো ক্ষতিকর হবে না। আমি ছাত্র-ছাত্রীকেও এমন পরামর্শ দেই।’