রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ক্লাস চলছে অনলাইনে। শিশুদের বয়স সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার। একটি শিশুর অভিভাবক শিক্ষককে বলছিলেন, ‘ম্যাডাম, আমার মেয়ে বাসায় কিছু শিখেছে, কিন্তু সে অনলাইনে ক্লাস করতে চায় না। জেদ ধরে। বলে স্কুলে যাব। নইলে পড়ব না।’
যে শিক্ষিকা শিশুদের ক্লাস নেন, তিনি তাদের বেশ স্নেহ করেন। সেই অভিভাবককে বলেন, ‘আমাদের অনলাইনে ক্লাস নিতে ভালো লাগে না। কিন্তু বাচ্চাগুলো বেঁচে থাকুক। একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি সবাই। একদিন নিশ্চয় এই পরিস্থিতি কেটে যাবে।’
করোনার প্রাদুর্ভাব এমন কোনো খাত নেই, যাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। এর মধ্যে শিক্ষা খাত বলতে গেলে তছনছ হয়ে গেছে। টানা দেড় বছর শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকায় কত লাখ শিশু ঝরে পড়েছে, তার হিসাব এখনও করতে পারেনি সরকার। তবে মন্দের ভালো হলো করোনা পরিস্থিতির উন্নতিতে শিক্ষাঙ্গনে ফিরেছে শিক্ষার্থীরা।
তবে এর মধ্যেও একেবারে ছোট্টদের জন্য স্কুলের দরজা এখনও বন্ধ। এই শিশুরা স্কুলে যেতে ব্যাকুল। তবে তাদের আরও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। কারণ প্রথম শ্রেণির আগ পর্যন্ত প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জড়ো করার ঝুঁকি নিতে চাইছে না সরকার। তাই তাদের ক্লাস অনলাইনেই হবে আপাতত।
তবে এই সিদ্ধান্ত শিশুদের মধ্যে শিক্ষায় নতুন বৈষম্য তৈরি করছে। পাশাপাশি অনলাইনে শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দেয়া গেলেও বন্ধুত্ব, একসঙ্গে চলার শিক্ষা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে শিশুরা একাকীত্বে ভুগছে। খিটখিটে আচরণ করছে অনেকেই।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা এখন দেয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ১২ বছর বয়সীদের। এর নিচে যারা তাদের মধ্যে যাদের স্কুলে আনা হচ্ছে, তাদের নিত্যদিন না এনে সপ্তাহে এক বা দুই দিন আনা হচ্ছে। আর প্রাথমিকের আগের শিশুদের ঘরে রেখেই দেয়া হচ্ছে শিক্ষা।
২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাবের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে দুই দফায়। প্রথম দফায় প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করে শিক্ষাঙ্গনের বন্ধ দুয়ার। সশরীরে ক্লাস শুরুতে চালু হয় মাধ্যমিক স্কুলে। এরপর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, সবার পর প্রাথমিকে।
করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে দ্বিতীয় দফায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করে দেয়া হয় গত ২১ জানুয়ারি। এই দফায় শিক্ষাঙ্গনে সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকে এক মাস। ২২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। তবে প্রাথমিকে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরও কয়েক দিন। ২ মার্চ থেকে শিশুদের হৈ-হুল্লোড়ে মুখর হবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। যদিও নিত্যদিন নয়, সপ্তাহে কয়েক দিন আসবে তারা।
তবে শিশু শ্রেণিতে প্লে থেকে কেজি পর্যন্ত পড়াশোনা করা শিশুদের ক্লাস অনলাইনেই চলবে। তাদের স্কুলে আনার সিদ্ধান্ত হবে, সে বিষয়ে এখনও চিন্তাভাবনাও করা হয়নি।
টিকাহীন শিশুদের নিয়ে ঝুঁকি নিতে চায় না সরকার
সহসাই প্রাক-প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস চালুর সম্ভাবনা নেই বলে আভাস দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, এত ছোট শিশুদেরকে করোনার টিকা দেয়া সম্ভব নয়। এই অবস্থায় তাদেরকে ভিড়ে এনে করোনার ঝুঁকিতে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার এ বিষয়ে বুঝে-শুনে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। কারণ এদের বয়স অনেক কম। আর এবারের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি স্কুল শিক্ষার্থীরাও করোনাভাইরাসে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। এ বিষয়টি আমাদের মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিন-তারিখ তো বলতে পারব না। করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
নতুন বৈষম্য
অনলাইনে শিক্ষায় সংকট একাধিক। যে পরিবারের অভিভাবকদের প্রযুক্তিজ্ঞান নেই, ইন্টারনেটের দুনিয়া থেকে যারা দূরে, যাদের আর্থিক সঙ্গতি নেই, সেই পরিবারের শিশুরা কার্যত শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এতে শিশুদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নতুন বৈষম্য।
নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো, যেখানে বড়রা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেনি, তাদের পক্ষে তাদের সন্তানদের শিক্ষা দেয়া সম্ভব নয়।
আবার স্কুলিং শুধু অক্ষরজ্ঞান বা পড়াশোনার বিষয় নয়। শিশুদের সামাজিক আচরণ, বন্ধুত্ব শেখার জায়গাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
আইনজীবী নাহিদা খানম বলছিলেন, তার মেয়ে স্বরিৎ ঋতি ভোর স্কুলে যেতে খুবই ব্যাকুল। সে খুবই খুশি ছিল। কিন্তু অনলাইন ক্লাস শুরুর পর থেকে তার অনেকটাই মন খারাপ। বিষয়টি তার সামগ্রিক আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সে অনলাইনে প্রতিদিন ক্লাস করতে চায় না। কেবল বলে স্কুলে যাব।
পিছিয়ে পড়া শিশুদের নিয়ে চিন্তিত শিক্ষাবিদরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দা তাহমিনা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হ্যাঁ, শিশুদের একটি বড় অংশ পিছিয়ে পড়ছে বা শিক্ষা থেকে দূরে সরে রইছে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এটি অবশ্যই ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় সমস্যা তৈরি করবে।’
তাহলে সমাধান কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি বলব, শিশুদের সপ্তাহে এক বা দুই দিনের জন্য হলেও স্কুলে আনা যেতে পারে। তাদের শিক্ষকরা অক্ষরজ্ঞান দিয়ে বাড়ির কাজ দিয়ে দিতে পারেন।’
শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকার প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিশুদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই মনে হয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুরা যেন শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কেননা অনেকের পক্ষেই অনলাইনে ক্লাস করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা করে সরকারকে এগিয়ে আসার। একই সঙ্গে এই শিশুদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের আরও যত্নবান হতে হবে।’
বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যে প্রাথমিক পরিকল্পনাও নেই, সেটি সংস্থাটির মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল ইসলামের বক্তব্যেই স্পষ্ট। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি অবশ্যই চিন্তার। প্রাক-প্রাথমিকের ক্লাস চালু হলে এ শিশুদের ঘাটতি পূরণে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
কিন্তু যেখানে ক্লাস শুরু নিয়ে অনিশ্চয়তায় যে সংকট, মনসুরুলের এই বক্তব্য সেটি উঠে এসেছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।