রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দরিদ্রদের ওপর করের বোঝা না বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি (বিইএ)। একইসঙ্গে যেসব সম্পদশালী নিয়মিত কর দেয় না তাদের কর হার বাড়ানোর প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া কালো টাকা রোধে ও পাচার করা অর্থ উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছে সমিতি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা সভায় বুধবার বিকেলে এ প্রস্তাব করেছেন বিইএ নেতারা।
সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের নেতৃত্বে কার্যনির্বাহক কমিটির প্রতিনিধি দল ‘২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের ভিত্তিনীতি: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির প্রস্তাবনা’ শীর্ষক লিখিত প্রস্তাব এনবিআরকে হস্তান্তর করে।
সেগুনবাগিচার এনবিআর সম্মেলন কক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে বিইএ সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম সমিতির পক্ষে লিখিত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।
এর আগে সকালে প্রাক-বাজেট আলোচনায় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য করপোরেট কর হার আরও কিছুটা কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘ধনী ও সম্পদশালী যারা সঠিকভাবে কর দেয় না, তাদের ওপর বেশি করারোপ করে গরিবদের ওপর থেকে করের বোঝা কমাতে হবে। একই সঙ্গে যারা সঠিকভাবে কর দেয় না, তাদের কাছ থেকে কর আদায় নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রস্তাবে অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা ও কোভিড পরিস্থিতিতে বিশ্বের সব দেশই এখন সব দিক থেকে মহা বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। এ অবস্থায় গতানুগতিক ধারায় থাকলে বাংলাদেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বাড়লেও বৈষম্য, অসমতা ও বহুমাত্রিক দারিদ্র্য দূর হবে না।
সমিতির মতে, এখন কর্মবাজার সংকুচিত ও বিপর্যস্ত। তার মধ্যে সাধারণ মানুষের ওপর নতুন খড়্গ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। এজন্য আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটকে কোনোভাইে ছোট করা যাবে না। সম্প্রসারণশীল ও বড় বাজেট করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে আলোচনা আওতা বাড়াতে কর আদায়ের নতুন নতুন খাত চিহ্নিত করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে করদাতাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কর আদায় ব্যবস্থার কথা বলেছেন তারা।
এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. মাসুদ সাদিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী সৈয়দ ইউসুফ সাদাত ও মুনতাসির কামাল প্রস্তাব তুলে ধরেন।
পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হতে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর রপ্তানিতে অনেক সুবিধা হারাব। ওই সময়ে আমাদের ব্যবসায়ীদের কর সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।
আমাদের কর্পোরেট কর হার প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এখন অনেক বেশি। তাই কর্পোরেট কর হার কমিয়ে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’
তিনি জানান, গত দুই বাজেটে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর কমিয়ে বর্তমানে দেশের কর্পোরেট কর হার ৩০ শতাংশ। আর শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এদিকে চীন, ভারত ভিয়েতনামসহ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর কর্পোরেট কর হার ক্ষেত্রবিশেষ ১৫ শতাংশেরও নিচে।
এসময় তিনি আরও বলেন, ‘এখনও বাংলাদেশের জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব হার ১০ শতাংশের নিচে। তাই আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে।’
অর্থনীতি সমিতির সদস্য জামাল উদ্দিন আহমেদ দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর ওপর টার্নওভার কর বসানোর পরামর্শ দেন।
আন্তর্জাতিক পরামর্শক সংস্থার ওপর কর কমানোর প্রস্তাব করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক মামুন রশিদ।
আলোচনায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেড স্নেহাশিষ বড়ুয়া সিটি করপোরেশনগুলোতে হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গে টিআইএন বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘এটা করা হলে কর আদায় বাড়বে।’
অনুষ্ঠানে সিপিডি প্রতিনিধি সৈয়দ ইউসুফ সাদাত আগামী বাজেটে তামাকের ওপর স্তরভিত্তিক কর আরোপ না করে শলাকা হিসাবে কর বসানোর প্রস্তাব করেন।