বিষমুক্ত ফুল, ফসল ও পাখিদের জন্য নিরাপদ আকাশ বিনির্মাণে ৩০ বছর ধরে পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ‘কৃষকের বন্ধু’ হিসেবে পরিচিত মতিন সৈকত। তার এই আন্দোলন ও পরিবেশ সচেতনতা বাড়ানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে ঢোল।
ঢোল পিটিয়ে কৃষকদের জড়ো করেন তিনি। এরপর তার বার্তা তুলে ধরেন। জানান, কীটনাশক ছাড়া কীভাবে নিরাপদ উপায়ে ফসল ফলানো যায়।
কেবল কীটনাশক ছাড়া ফসল উৎপাদন নয়, নদী রক্ষা, খাল খনন, অতিথি পাখি রক্ষা, কৃষককে কম খরচে সেচের ব্যবস্থাও করেছেন তিনি।
মতিন সৈকত কুমিল্লা দাউদকান্দি উপজেলার আদমপুর এলাকার বাসিন্দা। তবে গোটা জেলাতেই পরিচিত মুখ তিনি। কৃষকের পাশাপাশি ফুল, পাখি আর ফসল তার বন্ধু। স্বপ্ন দেখেন, তিনি যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন, সেগুলো নিয়ে কাজ হবে সারা দেশেই।
ঢোলের ব্যবহার কেন
শীতের মৌসুমে প্রতিদিন বিকেলে বাজে মতিনের ঢোল।
কেন লোক জড়ো করার প্রাচীন এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন?
মতিন সৈকত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে রাজা-বাদশারা প্রজাদের জরুরি বার্তা জানাতে ঢোল বাজিয়ে প্রচার করতেন। মানুষ গুরুত্ব দিয়ে তা শুনত। ঢোল পিটিয়ে কৃষকদের কাছে গেলে তারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে।
‘পরে তারা সেক্স ফেরেমন দিয়ে পোকা দমন করেন। জমিতে কাকতাড়ুয়া রাখেন। পাখি বসে পোকামাকড় ধরে খায়। রাতে ছোট বাতি জ্বালান জমিতে। এতে পোকামাকড় ধ্বংস হয়।’
নদী রক্ষায় আন্দোলন
কালা ডুমুর নামে একটি নদকে রক্ষায়ও কাজ করছেন মতিন সৈকত। তার আন্দোলনের ফলে কালাডুমুর নদের ১১ কিলোমিটার পুনর্খনন করা হয়। ২৩ কিলোমিটার নদের বাকি অংশটার পুনঃখননের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন এখন।
জালে আটকা পড়া পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেন মতিন সৈকত। ছবি: নিউজবাংলা
বর্ষায় কলকল শব্দে পানি প্রবাহিত হয় কালাডুমুর নদ দিয়ে। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা যখন কালাডুমুরের পানি ব্যবহার করে এমন দৃশ্য মতিন সৈকতের চোখে আনন্দ দেয়। শুধু কালাডুমুর নদই নয়, দাউদকান্দি উপজেলার বিভিন্ন খাল খননের বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
প্রাণী রক্ষা
কুমিল্লার নিম্নাঞ্চলের মধ্যে দাউদকান্দি একটি। বছরের বেশির ভাগ সময় পানি জমে থাকে। এসব জলাশয়ে মাছ চাষ করা হয়। জাল দিয়ে মাছ রক্ষায় সচেষ্ট থাকে ঘেরের মালিকরা। মাছ খেতে আসা পাখিরা বিভিন্ন সময় জালে আটকে পড়ে। বিশেষ করে বক, পানকৌড়ি, চিলসহ নানান প্রজাতির পাখি। জালে আটকা পড়া এসব পাখি উদ্ধার করেন৷ গত ৩০ বছরে অন্তত দেড় হাজার পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছেন।
কৃষকের ফাঁদে আটকা পড়া গুইসাপ, কচ্ছপ, বনবিড়াল, শিয়াল, বেজিসহ যেসব প্রাণী ফাঁদে আটকা পড়ে, সেগুলো উদ্ধার করে অবমুক্ত করেন। এমন শতাধিক প্রাণী উদ্ধার করে মুক্ত করেছেন তিনি।
কৃষকের ফাঁদে আটকা পড়া গুইসাপ উদ্ধার। ছবি: নিউজবাংলা
কম দামে সেচ
কৃষকের চাষের খরচ যেন কমে, সেই চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন মতিন সৈকত। শুষ্ক মৌসুমে প্রতি বিঘা জমি পানি সেচ দিতে এক থেকে দুই হাজার টাকা ব্যয় হয় কৃষকদের। সেখানে প্রতি বিঘা জমি সেচে কৃষকদের কাছ থেকে বিঘাপ্রতি নিচ্ছেন দুই শ টাকা করে।
এমন অন্তত দেড় শ বিঘা জমিতে প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা করেন তিনি।
পরিবেশ সচেতনতায় স্কুল
একটি বেসরকারি কলেজে বাংলা সাহিত্য পড়ান মতিন সৈকত। সম্প্রতি নিজের বাড়িতে স্থাপন করেছেন একটি স্কুল। এর নাম ‘বাংলাদেশ পরিবেশ স্কুল’ নামে পরিচিত। প্রতিদিন তিনি স্কুলে স্থানীয়দের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন।
এসব কাজে জাতীয়ভাবেও পুরস্কৃত হয়েছেন এই পরিবেশ আন্দোলন কর্মী। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ব্যবহার ও সম্প্রসারণে দুই বার বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিগত শাখায় ছয়বার চট্টগ্রাম বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন।
একাধিকবার জাতীয় পরিবেশ পদকের জন্য প্যানেলভুক্ত হন। ১৯৮৭ সৃজনশীল কাজের জন্য রাষ্ট্রপতির অভিনন্দনপত্র পেয়েছেন।
সারা দেশে আন্দোলনের স্বপ্ন
মতিন সৈকত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাখিরা যখন আকাশে ওড়ে, দৃশ্যটা খুব ভালো লাগে। নদীতে কলকল শব্দে পানির প্রবাহ আমাকে শান্তি দেয়৷
‘কৃষকদের উৎপাদিত ফসল যেন আমাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ হয়। এমন ভাবনা থেকে আমার কাজ শুরু করা।’
তিনি বলেন, ‘নিরাপদ কৃষি ফসল, নদী দূষণ রোধ ও পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলনটি আমি দাউদকান্দিতে শুরু করেছি, তা যেন পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাহলেই সোনার বাংলা বিনির্মাণ সম্ভব হবে।’
মতিন সৈকতের এসব উদ্যোগের প্রশংসা মানুষের মুখে মুখে।
কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শওকত আরা কলি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মতিন সৈকত একজন পরিবেশবাদী মানুষ। তিনি স্বেচ্ছায় পরিবেশ রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তার কাজগুলো আমি দেখেছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় একজন করে মতিন সৈকতের মতো লোক প্রয়োজন।’
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘মতিন সৈকত কৃষকদের নিরাপদ ফসল রক্ষায় যেভাবে উদ্বুদ্ধ করে চলছেন তা একটি দৃষ্টান্ত। মতিন সৈকতের জন্য শুভ কামনা থাকবে।’