যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরাতে চালকের লাইসেন্সকে পরোক্ষভাবে একটি অস্থায়ী বিষয় হিসেবে রাখার কথা বলা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইনে।
আইনের একটি ধারা অনুযায়ী, প্রতিটি লাইসেন্সের বিপরীতে ১২টি পয়েন্ট থাকার কথা। ৯ ধরনের আইন অমান্য করা হলে জরিমানা বা কারাদণ্ডের পাশাপাশি একটি করে পয়েন্ট কাটা যাবে, এভাবে পয়েন্ট শূন্য হলে তার লাইসেন্সই বাতিল হয়ে যাবে। একই রকমের অপরাধ দ্বিতীয়বার করা হলে পয়েন্ট কাটা যাবে দ্বিগুণ।
বিধানটি আইনে সংযুক্ত করার সময় সরকারি কর্মকর্তারা বলছিলেন, এটি সড়ক আইন মানার ক্ষেত্রে চালককে অনেকটা বাধ্য করবে।
কিন্তু বিধানটির প্রয়োগ নেই। এর কারণ, আইন হলেও সাড়ে তিন বছরেও বিধি করা যায়নি। এ কারণে একই অপরাধ বারবার বা একই চালক একাধিক অপরাধ করলেও তার লাইসেন্স নিয়ে কোনো হুমকি তৈরি হচ্ছে না।
এক বাইকচালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করছেন ট্রাফিক পুলিশ। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা
সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন, আইন করার পর বিধিমালা করার কথা ছয় মাসের মধ্যে।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, বিধিমালা না থাকলেও আইনের প্রয়োগে তেমন সমস্যা হচ্ছে না। যদিও মাঠপর্যায়ে কাজ করা ট্রাফিক সার্জেন্ট বলছেন বিপরীত কথা।
যে ঘটনায় আইন সংশোধন
২০১৮ সালের অক্টোবরে সড়ক পরিবহন আইন করার আগ পর্যন্ত যান চলাচলের শৃঙ্খলার বিষয়ে ১৯৮৩ সালের একটি অর্ডিন্যান্সের বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হতো। সেই আইনে জরিমানা এবং শাস্তির বিষয়টি ছিল বর্তমান সময়ের তুলনায় অপর্যাপ্ত।
২০১৮ সালের জুলাইয়ের শেষে ঢাকায় বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুজন কলেজছাত্র নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনের মুখে সড়ক আইন সংশোধন করা হয়।
সংশোধিত আইনে জরিমানা বাড়ানোসহ যেসব বিধান যুক্ত করা হয়, তাতে লাইসেন্সের বিপরীতে পয়েন্ট রাখা এবং সেই পয়েন্ট কাটার বিধানটিকে উন্নত বিশ্বের সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
প্রয়োগ নেই যে কারণে
প্রশংসিত এই বিষয়টির প্রয়োগ না করার বিষয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কর্মরত কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার।
দুর্জয় হাসান নামের একজন সার্জেন্ট বলেন, ‘বিধিমালা হাতে না পাওয়ায় সড়ক পরিবহন আইনের শতভাগ প্রয়োগ করাও সম্ভব হচ্ছে না।
‘হেলমেট না থাকা, ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার মতো বিষয়ে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ অল্প কিছু ধারা প্রয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু বেশির ভাগ বিধানই কার্যকর করা যাচ্ছে না।’
২০১৮ সালের আইনে জরিমানায় আদায়ে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে হেলমেটের মামলা দেয়া হতো প্রথমবার ২০০ টাকা, দ্বিতীয় বার ৪০০ টাকা। আর এখন এই অপরাধে প্রথমবার জরিমানা করা হয় ১ হাজার, দ্বিতীয় বার দুই হাজার টাকা। এরপরও যদি কেউ আইন অমান্য করে, তাহলে প্রতিবারের জন্য দুই হাজার টাকা করে জরিমানা গুনতে হয়।
‘ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য এখন জরিমানা করা হয় চার হাজার টাকা। আগে করা হতো ২০০ টাকা।’
রাজধানীতে মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে বিআরটিএ। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা
তবে বিধিমালা না থাকায় রুট পারমিট না থাকা, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, রুট মেনে গাড়ি চলাচল না করার বিষয়গুলোতে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে জানালেন অন্য একজন সার্জেন্ট।
একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় দিনের বেলায় বড় গাড়ি চলা নিষেধ। এই আইনটা আগে ছিল। নতুন আইনে এর বাস্তবায়ন নাই। পুরাতন বিধিমালা দিয়ে চালাচ্ছি। এসব গাড়ি ঢুকতে দিলে তো পুরা সিস্টেমই নষ্ট হয়ে যাবে।’
কী বলছে বিআরটিএ
বিষয়টি নিয়ে ট্রাফিক অ্যাডমিন অ্যান্ড রিসার্চের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার শফিকুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিধিমালা তৈরি মূলত বিআরটিএর বিষয়। যখন এই আইনটির বিধিমালা তৈরি হবে, তখন এটা কার্যকর হবে। আমি যতদূর জানি, এটার কাজ চলছে। বিধিমালা শিগগির কার্যকর হবে।’
বিধিমালা না থাকার বিষয়টি অবশ্য স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী।
সাড়ে তিন বছরেও বিধিমালা করতে না পারার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইনের চেয়ে বিধিমালা হয় ১০ গুণ বড়। এটা দু-এক পৃষ্ঠা না।’
কবে নাগাদ নতুন বিধিমালা তৈরির কাজ শেষ হবে, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সেটা সরকার বলতে পারবে। সরকারের হাতে এটা। আমরা আশা করছি, দু-এক মাসের মধ্যে চলে আসবে।’
নতুন বিধিমালা না হওয়ায় আইনের প্রয়োগে তেমন সমস্যা হচ্ছে না- এমন দাবিও করেন এই কর্মকর্তা। পরে তাকে চালকের লাইসেন্সের পয়েন্ট কাটার প্রসঙ্গটি জানালে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয় আসছে, সেগুলো হয়তো নতুন বিধিমালা জারি হওয়ার পরে হবে।’
ছয় মাসে হওয়ার কথা, সাড়ে তিন মাসে কেন হবে না
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটি আইন যখন পাস হয়, তার ছয় মাসের মধ্যে বিধি প্রণয়নের নিয়ম। কিন্তু আমাদের এখানে বিধিমালা প্রণয়ন দুই থেকে পাঁচ বছরেও হয় না।’
সেটা তৈরি করতে না পারাকে ব্যর্থতাই বলতে চান জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। এর জন্য গাফিলতি এবং অবহেলা আছে বলে মনে করেন তিনি।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ বলছে, সরকার আন্তরিক নয় বলেই বিধিমালা তৈরিতে কালক্ষেপণ হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের দুর্ভাগ্য, মানুষ এটা সাফার করবে। এ ছাড়া যারা সুবিধাভোগী, তারাও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছে।’
যেসব কাজে পয়েন্ট কাটা যাওয়ার কথা
১. লাল বাতি অমান্য করে মোটরযান চালানো;
২. পথচারী পারাপারের নির্দিষ্ট স্থানে বা তার কাছে বা ওভারটেকিং নিষিদ্ধ স্থানে ওভারটেক;
৩. মোটরযান না থামিয়ে সরাসরি প্রধান সড়কে প্রবেশ;
৪. সড়কে নির্দেশিত গতিসীমা লঙ্ঘন;
৫ ইচ্ছাকৃত পথ আটকে বা অন্য কোনোভাবে মোটরযানের চলাচলে বাধা সৃষ্টি;
৬. একমুখী সড়কে বিপরীত দিক থেকে মোটরযান চালানো;
৭. বেপরোয়া ও বিপজ্জনকভাবে মোটরযান চালানো ও ওজনসীমা লঙ্ঘন;
৮. মদ্যপ বা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মোটরযান চালানো;
এবং
৯. বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য যেকোনো বিষয়ে।