২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্ণ হলো আজ।
১৯৫২ সালের পর নিয়মিত এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারি-বেসকারি বিভিন্ন সংগঠন, রাজনৈতিক দল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে দিনটি পালন করে।
তবে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস এখনও অনেকেই জানেন না। এমনই একজন ভাষাসংগ্রামী ডা. মঞ্জুর হোসেন। প্রথম শহীদ মিনার যাদের হাতে তৈরি, তিনি তাদের একজন।
নওগাঁ সদর উপজেলার সুলতানপুর এলাকার সন্তান ডা. মঞ্জুর হোসেন। বাবা মোবারক আলী ও মা নুরুন নাহারের আট সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।
মঞ্জুরের জন্ম ১৯২৮ সালে ১৫ জুন। ১৯৬৮ সালে ৪ ডিসেম্বর ৪০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। বাড়ির পাশে পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত তিনি।
শিক্ষা ও কর্মজীবন
১৯৪৩ সালে নওগাঁ কেডি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৪৫ সালে কলকাতা থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৯ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে ডিগ্রি অর্জন করেও চাকরি না করে আজীবন সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এমবিবিএস পাশ করে নিজ জন্মস্থানে পেশাজীবন শুরু করেন। তার চার ছেলে ও দুই মেয়ে।
ভাষা আন্দেলনে ভূমিকা
ডা. মঞ্জুর তখন ঢাকা মেডিক্যালের শেষ বর্ষের ছাত্র। ১৯৪৯ সালে সরকারি স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দিবসে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে গোলাম মাওলার কক্ষে ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এতে সংগ্রাম কমিটিতে মতবিরোধ দেখা দেয়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘৪৪ ধারা ভাঙবই ভাঙব।’
মেডিক্যাল ব্যারাকে এক স্বতস্ফূর্ত সমাবেশে প্রতিবাদী বক্তব্য দিয়েছিলেন ডা. মঞ্জুর হোসেন। রাতে ফজলুল হক হলের পুকুর পাড়ে ১১ জন ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিতে গোপন বৈঠকে বসেন। সেখানে ঢাকা মেডিক্যালের কলেজের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হলে শিক্ষার্থীরা চারজন করে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে সত্যাগ্রহে অংশ নেয়। স্লোগান দিয়ে বের হলে পুলিশ ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তোলে।
এক পর্যায়ে প্রায় ১০ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ ও কাঁদানো গ্যাসের মধ্যে দিয়ে মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে আসেন। বেলা ৩টায় পরিষদের অধিবেশনের আগেই ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ শুরু হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ বিকেল ৪টার দিকে গুলি চালায়। এতে অনেকেই শহীদ হন।
সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী, ডা. মঞ্জুর হোসেন ও আকমল হোসেন। দ্বিতীয় দলে ছিল ইব্রাহিম তোয়াহা, আব্দুস সামাদ, আনোয়ারুল হক খান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।
ছাত্রীদের মধ্যে শাফিয়া খাতুন, নিলীমা ইব্রাহিম, রওশন আরা বাচ্চু ও শামসুন নাহার।
২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে কয়েকজন ছাত্রনেতা শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে রাতে নিজেরা ইট, সিমেন্ট ও বালু দিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এই প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম কারিগর ছিলেন ডা. মঞ্জুর হোসেন।
পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। ভাষা আন্দোলনে সাহসী ও সংগ্রামী ভূমিকার জন্য সহযোদ্ধারা তাকে ‘বিপ্লব দা’ উপাধি দিয়েছিলেন।
ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়ায় করাভোগ করতে হয় মঞ্জুরকে। আন্দোলন ছাড়াও এ দেশের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সৈনিক ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ায় ১৭ বার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
করেছিলেন সাংবাদিকতাও
চিকিৎসার পাশাপাশি মঞ্জুর সাংবাদিকতার সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। বাবার উদ্যোগ ও সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাপ্তহিক দেশ বাণী’র সম্পাদনার দায়িত্ব নেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬৪ সালে ‘তহশীলদারের দুর্ব্যবহার পরিণামে গলায় গামছা’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হলে পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলায় হয়। এতে নিম্ন আদালতে তিন মাস কারাদণ্ড হয়। পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন। এ ছাড়া তিনি আবৃত্তি, সংগীতচর্চা ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
মঞ্জুর হোসেনের তৃতীয় ছেলে সাবেক কাউন্সিলর হাসান ইমাম তমাল নিউজবাংলাকে বলেন, যে ১১ জনের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভাঙা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম আমার বাবা। বিশ্বের মধ্যে একমাত্র আমরাই ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছি।
‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম শুরু হয়ে ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীনের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। ভাষা সংগ্রামে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার ২০০২ সালে বাবাকে একুশে পদক (মরণোত্তর) দেয়া হয়। সে সময় ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের অনেকেই এখনো স্বৃকীতি পাননি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি এলে শহীদ মিনারে আমরা হুড়োহুড়ি করে ফুল দেই। এখনো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নাই। আগামী প্রজন্ম জানবে না শহীদ মিনার আসলে কী।
‘সরকারের উচিত পাঠ্য বইয়ের সিলেবাসে ভাষা সৈনিকদের আত্মজীবনী তুলে ধরা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মর্যাদা দেয়া।’
সারা দেশে একই আদলে শহীদ মিনার তৈরির পাশাপাশি নওগাঁয় বড় আকারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরি দাবি জানান তিনি।
স্বামীর স্মৃতিচারণ করে স্ত্রী জাকেরা জামানী বলেন, ‘একদিন বিকেলে বাজার করার জন্য ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ি ফিরেনি। পরে লোকজন এসে জানায় স্বামীকে পুলিশ ধরে গেছে।
‘সন্ধ্যার পর ছেলেরা বাজার করে নিয়ে আসার পর রাতের রান্না হয়। তিনি নিজের জন্য কিছুই করেননি। সমস্যার মধ্যে তার জীবন কেটেছে। অনেকবার জেল খেটেছেন।’
ডা. মঞ্জুরের চাচাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তিনি ছিলেন সিংহপুরুষ। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকে দেখতাম ভাই ছিলেন পরিশ্রমী ও মিশুক। এরপর আমাদের যখন একটু বুদ্ধি হলো তখন তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়াশুনা শুরু করেন। তখন তার কাছ থেকে শুনতাম ভাষা আন্দোলনের কথা। যা শুনে আমাদের গা শিহরিত হয়ে উঠত।’
একুশে পরিষদ নওগাঁর সভাপতি ডিএম আব্দুল বারী বলেন, ‘১৯৫২ সালে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সামনের সারিতে যারা ছিলেন তাদের অন্যতম ডা. মঞ্জুর হোসেন। ভাষা সংগ্রামে তার অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বিনামূল্যে রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। ’
তিনি বলেন, ‘ভাষা সৈনিকদের মধ্যে স্থানীয়ভাবে ১৯৯৫ সালে ডা. মঞ্জুর হোসেনকে প্রথম একুশে পরিষদ পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এমনকি তিনি যেখানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত আছেন সে কবরটিও অনেকগুলো কবরের মধ্যে শনাক্তকরণ ছিল না। পরে একুশের পরিষদ নওগাঁর উদ্যোগে ২০১১ সালে কবর শনাক্ত করে বাঁধাই করে ফলক লাগানো হয়। যেখানে প্রতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তার রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও পুষ্পস্তর্বক অর্পণ করা হয়।
এ ভাষা সৈনিকের জীবনী স্মরণ করে জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এবিএম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভাষার জন্য যখন ঢাকায় আন্দোলন শুরু হয়, তখন আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়। এতে অনেকেই শহীদ হন। এরপর ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সে সময় তার (ডা. মঞ্জুর) বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হলে নওগাঁয় চলে আসেন। এরপর ডা. আমজাদ হোসেন, অ্যাডভোকেট বয়তুল্ল্যাহ, এমএ রকীব ও খন্দকার মকবুল হোসেনকে নিয়ে ভাষা সংগ্রাম সংগঠিত করে হরতাল ও অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।’