ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার কামারখালী ইউনিয়নের রউফনগর গ্রাম। এ গ্রামের আলো-বাতাসেই বেড়ে উঠেছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। কিন্তু নদীভাঙনে রাস্তা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একটি বিচ্ছিন্ন জনবসতিতে পরিণত হয়েছে গ্রামটি।
গ্রামের একাংশে বীরশ্রেষ্ঠর জন্মভিটা। স্বাধীনতার কিছুদিন পর এই ভিটায় তৎকালীন সরকারের বানিয়ে দেয়া পাকা ঘরটি এখন জরাজীর্ণ, বসবাসের অনুপযোগী।
কামারখালীতে মহাসড়কের পাশে সরকারিভাবে নির্মিত ভবনে থাকেন বীর পরিবারের সদস্যরা। তাই মুন্সী আব্দুর রউফের স্মৃতিবিজরিত বাড়িটিতে খুব বেশি নজর দেন না তারাও।
রউফনগর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর নামে একটি ভবনও দাঁড়িয়ে আছে। জাদুঘর থাকলেও তাতে দেখার মতো নেই তেমন কিছু। ফলে হতাশ হন দর্শনার্থীরা।
গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের বড় একটি কক্ষের ভেতর রয়েছে মুন্সী আব্দুর রউফের ব্যবহার্য চিনামাটির দুটি তৈজস, বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দুটি পোস্টার আর কিছু বই। স্মৃতি জাদুঘরে ‘স্মৃতি’ বলতে এতটুকুই। সেখানে যাওয়ার সড়কটি নদীভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে।
এ গ্রামেই ১৯৪৩ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করেন মুন্সী আব্দুর রউফ। ১৯৬৩ সালের ৮ মে তৎকালীন ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) বাহিনীতে যোগ দেন এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল রাঙ্গামাটির মহালছড়ি নৌপথে বুড়িঘাট এলাকায় পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধে শহীদ হন আব্দুর রউফ। প্রত্যক্ষদর্শী বুড়িঘাটের চিংড়িখালের বাসিন্দা দয়াল কৃষ্ণ চাকমা তাকে সমাহিত করেন।
তার স্মৃতির উদ্দেশে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ২০০৭ সালের ১৭ নভেম্বর। জেলা পরিষদের ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় ৩ হাজার ৫৩৫ বর্গফুটের এই স্থাপনাটি। ২০০৮ সালের ২৮ মে উদ্বোধন করা হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, ওই গ্রন্থাগারে মোট ৫ হাজার ১৮৮টি বই রয়েছে। এসব বইয়ের বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুবিষয়ক। পাঠকদের বসার জন্য পাঁচটি টেবিল ও ৪০টি চেয়ার রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছেন দুজন।
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগারে ৫ হাজার ১৮৮টি বই রয়েছে
বীরশ্রেষ্ঠের চাচাতো ভাই ও গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মুন্সী সাইদুর রহমান বলেন, ‘দর্শনার্থীরা প্রায়ই প্রশ্ন করেন- গ্রন্থাগার রয়েছে কিন্তু জাদুঘর কোথায়? তাদের এমন প্রশ্নে চুপ থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় পাঠক-দর্শনার্থীরা আসেন না তেমন।’
এলাকাবাসী জানান, কোনো জাতীয় দিবস, এমনকি বীরশ্রেষ্ঠের মৃত্যুবার্ষিকীও এখানে সরকারিভাবে পালিত হয় না। মৃত্যু দিবসটি পালিত হয় পরিবারের উদ্যোগে। এতে অবশ্য জেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের অনুদান থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রন্থাগারে মাত্র দুটি জাতীয় পত্রিকা রাখা হয়। তা পড়তে দু-চারজন পাঠক আসেন প্রতিদিন। তাদেরই একজন স্থানীয় আওয়াল মোল্লা।
৬৭ বছরের আওয়াল মোল্লা জানান, তার মতো হাতেগোনা কয়েকজন আসেন পত্রিকা পড়তে। অথচ আগে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও আসতেন। যাতায়াতের সড়কটি ঠিক হলে গ্রন্থাগারে পাঠক বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
কামারখালী বাজার থেকে রউফনগর গ্রামে একটি সড়ক গেছে। ১০ বছর ধরে সড়কটির গন্ধখালী এলাকায় মধুমতি নদীর ভাঙন চলছে। এতে সড়কটির প্রায় দেড় কিলোমিটার অংশ হেঁটেও পার হওয়া কঠিন।
গন্ধখালী এলাকার জহুরুল মোল্লা বলেন, ‘দেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের একজন মুন্সী আব্দুর রউফ। তার বাড়িতে যাওয়ার রাস্তাটির এমন দশা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।’
ওই গ্রামেরই মতিয়ার মোল্লা বলেন, ‘সড়কটির বেশির ভাগই বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান ভেঙে যাওয়া অংশে বালুর বস্তা দেয়ার কারণে তার ওপর দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারে কোনোমতে। গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক দর্শনার্থী এই স্থান থেকেই ফিরে যান।’
জাহাঙ্গীর হোসেন নামে আরেকজন বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের জন্ম আমাদের এলাকায় হওয়ায় আমরা গর্ববোধ করতাম। গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর এখানে হওয়ায় আমরা ভেবেছিলাম এলাকার অনেক উন্নয়ন হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি।’
কামারখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুর রহমান বিশ্বাস বাবু বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার সড়কটির গন্ধখালীসহ কয়েক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙনরোধে জিও ব্যাগ ফেলেছে। কিন্তু প্রতি বছরই নতুন নতুন জায়গায় ভাঙন দেখা দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে মধুখালী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মুরাদুজ্জামান মুরাদ বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার রাস্তাটি সংস্কারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের খাসজমি দেয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। ভাঙন এলাকায় জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া মধুমতির ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারেও কথাবার্তা চলছে।’
মধুখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক বকু বলেন, ‘সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান নিজ উদ্যোগে বেশ কয়েকবার নদীভাঙনের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কয়েক দফা কাজও হয়েছে। তবে স্থায়ী সমাধান হয়নি।’
রউফনগর গ্রামে যেতে সড়কটির বেশির ভাগ অংশই বিলীন হয়ে গেছে
এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ফরিদপুর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমি উপজেলা প্রকৌশলীকে নিয়ে ওই সড়ক দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তাটি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নদীর পাড় বাঁধা না হলে রাস্তা নির্মাণ করা যাচ্ছে না। নদীর পাড় বেঁধে দিলে আমরা দ্রুত রাস্তা করে দেব।’
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও ব্যাগ ফেলার পাশাপাশি নদী তীরের সাত কিলোমিটারে বাঁধ দিতে ৪৮১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।’
তিনি জানান, গন্ধখালী এলাকাটি নদীর টার্নিং পয়েন্ট হওয়ায় এই এলাকায় সব সময় ভাঙনের ঝুঁকি থাকে। পানি বাড়লেই ভাঙন দেখা দেয়। তাই সেখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের বসতভিটাটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয় ইতোমধ্যেই মধুমতি নদীর ভাঙন থেকে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি রক্ষা করতে এলাকা পরিদর্শন করেছেন।’