ভাষার জন্য আত্মত্যাগের মহত্ত্ব তুলে ধরে রক্তমাখা রাজপথ নিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান লেখেন কবি শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ।
তার ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি, তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’ গানটি পরে ব্যাপক সমাদৃত হয়, অনুপ্রেরণা জোগায় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর যোদ্ধাদেরও।
স্বল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গানটি। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হলেও গানটির গীতিকার ও সুরকার এ কবি আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি বলে জানা গেছে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, লোককবি শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ ১৯১৫ সালে বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় তৎকালীন বাগেরহাট টাউন স্কুল (বর্তমানে বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুল)।
অভাবের কারণে বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেননি তিনি। তবে ছোটবেলা থেকেই ‘কবিতা ও গানের প্রতি তীব্র ঝোঁক ছিল শামসুদ্দিনের।
কবির বাড়ি। তার পরিবার এখনও রয়েছে অভাবের মধ্যে। ছবি: নিউজবাংলা
ভক্ত ছিলেন পল্লিগীতির সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের। তবে তিনি পেশায় ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলে পাকসেনাদের নির্বিচার গুলিতে ছাত্র নিহতের ঘটনার দিন রাতেই তিনি রচনা করেন ‘রাষ্ট্রভাষা’ শিরোনামের গানটি।
পরদিন ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাগেরহাটের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শেষে সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংক মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশে তিনি গানটি গেয়ে উদ্বুদ্ধ করেন ছাত্র-জনতাকে। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন স্থানে তার এ গান গেয়েই আন্দোলনে গতি আসে। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সে গান।
জানা যায়, একটা সময় এ গানের সূত্র ধরেই মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেকের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৫৩ সালে খুলনার দ্য ইস্টার্ন প্রেস থেকে পাকিস্তান পল্লিগীতি নামে তার লেখা গানের একটি সংকলন প্রকাশ হয়। সেখানে তার এই বিখ্যাত গানসহ মোট ১৬টি গান ছাপা হয়।
তবে মুক্তিযুদ্ধের আগে পাকিস্তান সরকার বিরোধীদের তালিকা তৈরি করছে এ আশঙ্কায় তিনি নিজের লেখা পুড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হন। পরে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে মারা যান।
কবির বাড়িতে ঢুকতে প্রথমেই চোখে পড়ে তার বাঁধানো কবর। ছবি: নিউজবাংলা
সরেজমিন বাগেরহাটের ফতেপুর কবির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনেই রয়েছে কবির কবর। শামসুদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এর মধ্যে বড় মেয়ে লাইলি বেগম মারা গেছেন বছরখানেক আগে। ছোট ছেলে মুকুল শেখ ঢাকায় চাকরি করেন। বাড়িতে থাকেন শুধু মেজো ছেলে। তবে অভাব-অনটনের মধ্যে কবির মেজো ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকনও ভুগছেন নানা রোগে।
তিনি বলেন, ‘বাবা হাট-বাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন আর গান বাঁধতেন। তিনি নিজে গান লিখতেন, সেগুলোর সুর করতেন আবার নিজেই গাইতেন সেগুলো।
ভাষা আন্দোলনের সময় তার রাষ্ট্রভাষা নামের গানটি ছাত্র-জনতাকে ব্যাপক উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার বাবা আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে শুধু স্থানীয়রাই বাবার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ ছাড়া চরম দারিদ্র্যের মধ্যে থাকলেও আমি বা আমার পরিবারের কেউ সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা পাইনি।’
এ বিষয়ে ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ‘কবি শেখ শামসুদ্দিন ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। ভাষা আন্দোলনের সময় তার লেখা গান দেশে আলোড়ন তুলেছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে ছাত্র-জনতার মধ্যে। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হলেও এখনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তিনি পাননি।
‘সরকারের কাছে আমাদের দাবি, ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের এ গীতিকার ও সুরকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক।’
বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন টগর বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে কবির সম্মানে তার বাড়ির সামনে একটি গেট, কবরটা বাঁধানোসহ তার নামে একটি পাঠাগার নির্মাণ করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি স্বীকৃতি পাননি। সরকারের কাছে প্রায়ত এ কবির মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানাই।’
এ বিষয়ে বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জানতে পেরেছি কবির পরিবারও আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার চেষ্টা করছি।’
এ ছাড়া তার পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতারও আশ্বাস দেন ডিসি।