ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলায় যে নির্বাচন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে, ভোট চলাকালে তার ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে সেই টাকার সিংহভাগ স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে সরিয়ে নেন সেই নির্বাচন কর্মকর্তা। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলছেন, তিনি শ্বশুরকে টাকা ধার দিয়েছিলেন। সেই টাকা ফেরত পেয়ে ব্যাংকে রেখেছিলেন।
গত ২৮ নভেম্বর চরভদ্রাসনের ১১টি ইউনিয়নে ভোট হয়। মনোনয়ন দাখিলের পর থেকে বিভিন্ন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করার ভয় দেখিয়ে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠতে থাকে সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
এক হাজার ৭ ইউনিয়নে ২৮ নভেম্বর ভোটের তারিখ জানিয়ে গত ১৪ অক্টোবর তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। প্রার্থিতা জমা দেয়ার সুযোগ ছিল ২ নভেম্বর পর্যন্ত। মনোনয়নপত্র বাছাই করা হয় ৪ নভেম্বর, প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল ১১ নভেম্বর।
ভোটের পর গত ৩০ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে গাজীরটেক ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আহসানুল হক মামুন ও একই ইউপির ১ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রার্থী আব্দুর রউফ নির্বাচন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন।
তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব (সংস্থাপন-১) জিলহাজ উদ্দিন ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান তদন্তে নেমে সাইফুলের সোনালী ব্যাংক হিসাবে প্রায় ২৪ লাখ টাকা গচ্ছিত পেয়েছেন।
গত বছরের অক্টোবর মাসের শেষের দিক থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় এই টাকা জমা পড়েছে।
সাইফুল ইসলামের সোনালী ব্যাংক শাখায় একটি হিসাব রয়েছে। ভোট চলাকালে কোনো দিন এক লাখ, কোনো দিন দেড় লাখ, কোনো দিন দুই লাখ টাকা জমা রাখা হয়।
এক লাখ বা ৮০ হাজারের মতো ঘুষের টাকাগুলো নির্বাচন অফিসের কর্মচারী দিয়ে ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন এবং দুই লাখ বা আড়াই লাখের মতো অঙ্কগুলো তিনি নিজেই জমা দিয়েছেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার উৎস জানতে চেয়ে চিঠি দিলে সেই নির্বাচন কর্মকর্তা ২৪ লাখ টাকাই তার পারিবারিক লেনদেনের অর্থ বলেছেন।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘চরভদ্রাসন উপজেলার নির্বাচন অফিসার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তদন্ত চলছে। তার ব্যাংক হিসাব তলব করা তারই অংশ। আর তার অভিযোগটি তদন্তাধীন। এ জন্য আর কিছু জানাতে পারছি না।’
অভিযোগকারীরা কী বলছেন
গাজীরটেক ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকা মার্কায় ভোটে লড়া আহসানুল হক মামুন জানান, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর নির্বাচন কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রার্থিতা বাতিল করার ভয় দেখিয়ে প্রথম দফায় নগদ পৌনে দুই লাখ টাকা এবং পরে আরও দুই দফায় ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন।
সাইফুল ইসলামের সোনালী ব্যাংক শাখায় একটি হিসাব রয়েছে। ভোট চলাকালে কোনো দিন এক লাখ, কোনো দিন দেড় লাখ, কোনো দিন দুই লাখ টাকা জমা রাখা হয়। এক লাখ বা ৮০ হাজারের মত ঘুষের টাকাগুলো নির্বাচন অফিসের কর্মচারী দিয়ে ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন এবং দুই লাখ বা আড়াই লাখের মতো অঙ্কগুলো তিনি নিজেই জমা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘ওই কর্মকর্তা মিথ্যাচার করছেন। তার শ্বশুর টাকা ধার নিয়ে আমার নির্বাচনের সময়ই সেই টাকা ফেরত দিলেন, এই বক্তব্য একেবারে ভিত্তিহীন। আর ওই কর্মকর্তা যদি টাকা ধার নিয়ে থাকবেন, তাহলে সেই টাকা কেন তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে রাখবেন?’
একই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) পদে নির্বাচনে অংশ নেয়া আব্দুর রউফ জানান, মনোনয়নপত্র দাখিলের দিন কাগজপত্র পরীক্ষা করে সবকিছু ঠিক আছে বলে জানিয়ে দেন নির্বাচন কর্মকর্তা। তবে দুই দিন পর তিনি অফিসে ডেকে নিয়ে মনোনয়নপত্রের কোনো এক স্থানে সই না থাকার কথা বলে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাবে বলে জানান। এ কথা বলে ৩ নভেম্বর ১৫ হাজার এবং ৪ নভেম্বর আরও ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার পদে লড়াই করা শেখ শহীদুল ইসলামের স্ত্রী হাসিনা বেগম জানান, ভোট চলাকালে সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামীর পা ভেঙে যাওয়ার পর নানা কথা বলে ৪ নভেম্বর ২৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন সাইফুল ইসলাম।
চরহরিরামপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়াই করা জুলহাস শিকদার জানান, নির্বাচনী প্রচার চলাকালে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যাবে বলে হুমকি দিয়ে ৪ ও ৫ নভেম্বর দুই দফায় ৮০ হাজার টাকা নিয়েছেন।
একই ইউনিয়নের আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী মোহাম্মদ আলীর অভিযোগ করেন তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা এবং সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আবদুল বারেক মণ্ডলের কাছ থেকে নগদ ৪ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন সেই নির্বাচন কর্মকর্তা।
তদন্তের মধ্যে স্ত্রীর হিসাবে টাকা স্থানান্তর
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের সেই টাকার মধ্যে থেকে তার স্ত্রী ফেরদৌসী বেগমের ব্যাংক হিসাবে ২০ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন।
সাইফুলের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগমও একজন নির্বাচন কর্মকর্তা। তিনি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলায় কর্মরত।
সাইফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার শ্বশুর আমার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। সেই পাওনা টাকা আমাকে ফেরত দিলে উক্ত টাকা আমি ব্যাংকে জমা করার পর আবার আমার স্ত্রীর হিসাবে ট্রান্সফার করেছি। আর এর প্রতিবেদন ব্যাংকে জমা দিয়েছি। আর আমি কোনো ঘুষ গ্রহণ করিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ব্যাংক হিসাবের খবর সাংবাদিকরা জানল কীভাবে? আমি ব্যাংকের বিরুদ্ধে এলিগেশন দেব।’
তার শ্বশুর কী করেন, ২০ লাখ টাকা তিনি কেন কবে ধার নিয়েছিলেন, সেই টাকা সাইফুল কোথায় পেয়েছেন- এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি এই নির্বাচন কর্মকর্তা কথা বাড়াতে আগ্রহী না হওয়ায়।
তার স্ত্রী ফেরদৌসী বেগমও একজন নির্বাচন কর্মকর্তা। তিনি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় কর্মরত। তার কাছ থেকেও সেই টাকার বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলবেন না বলে ফোন কেটে দেন।