বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

নীতিমালায় থাকলেও মাতৃভাষায় শিক্ষাবঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী

  •    
  • ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৭:৩৩

জাতীয় শিক্ষানীতিতে সব জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের সুযোগের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তার তেমন বাস্তবায়ন নেই। শিক্ষানীতি প্রণয়নের ১২ বছরে মাত্র পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের কিছু বই প্রকাশ করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত দেশে উপেক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা।

সড়কের পাশের খুঁটিতে ফেস্টুনটি টানানো। তাতে লেখা- ‘কুরিয়ান ভাষা শিখতে চাইলে আজই চলে আসুন’। পাশেই দেয়ালে সাঁটানো আরেকটি পোস্টার- ‘এখানে ফরাসি ভাষা শিখানো হয়’।

সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকায় এই সড়ক পেরোনোর সময় এসব ফেস্টুন-পোস্টার দেখিয়ে মণিপুরী তরুণ সঞ্জয় সিংহ বললেন, ‘দেশে এখন ইংরেজি ছাড়াও অনেক বিদেশি ভাষা শেখানো হয়। কিন্তু আপসোস, দেশের ভেতরের ক্ষুদ্র ভাষাগুলোয় শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ নেই।’

সঞ্জয়ের এই আফসোসের সঙ্গে একমত পোষণ করে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি এ কে শেরাম বলেন, ‘আমাদের তো সাংবিধানিক স্বীকৃতিই নেই। আমাদের যে নিজস্ব ভাষা আছে, ঋদ্ধ সংস্কৃতি আছে; তা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকার করেনি। সংবিধানমতে, আমরা উপজাতি। একে তো রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষা শিক্ষার কোনো উদ্যোগ নেই, তার ওপর অর্থনৈতিক উপযোগিতা না থাকায় মণিপুরী তরুণ প্রজন্ম এখন এই ভাষাটা শিখতেও আগ্রহী নয়।’

কেবল মণিপুরী নয়, মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত দেশের বেশির ভাগ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিশুরা। যদিও ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে ‘প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করার’ কথা বলা হয়েছে। আর ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণাকালে উল্লেখ করা হয়- সব ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা, সংরক্ষণ ও সমানাধিকার প্রদানই এই দিবসের উদ্দেশ্য।

বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত দেশে উপেক্ষিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা। জাতীয় শিক্ষানীতিতে সব জাতিসত্তার মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের সুযোগের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত তার তেমন বাস্তবায়ন নেই। শিক্ষানীতি প্রণয়নের ১২ বছর পেরিয়েছে। এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় প্রাক-প্রাথমিকের কিছু বই প্রকাশ করা হয়েছে।

দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী রয়েছে প্রায় ৪৫টি। এদের অনেকের নিজস্ব ভাষার লিপি ও বর্ণমালা রয়েছে। তবে শিক্ষা ও চর্চার সুযোগ না থাকায় এসব ভাষার বেশির ভাগই হারিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি ভাষায় সরকারি উদ্যোগে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কিছু বই প্রকাশ হয়। তবে প্রশিক্ষিত লোকের অভাবে এসব ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আর বাকি জনগোষ্ঠীর ভাষায় বই-ই এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে প্রকাশ হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের হিসাবমতে, সিলেট বিভাগে এ বছর ত্রিপুরা, গারো ও সাদরি ভাষার ৬৭৫ শিক্ষার্থীকে তাদের মাতৃভাষায় বই দেয়া হয়েছে। তবে সিলেটে মণিপুরী আর খাসিয়া জনগোষ্ঠীই আছে প্রায় দুই লাখ। কিন্তু এই দুই গোষ্ঠীর শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় বই পায়নি।

সিলেট বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মোসলেম উদ্দিন শনিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। উপজেলা পর্যায় থেকে চাহিদা পাঠালে সরকার বই প্রস্তুত করে চাহিদামাফিক বিতরণ করে।

‘মণিপুরী ভাষা ও কৃষ্টির ঐতিহ্যর কথা তো আমিও জানি। এই ভাষায় এখন পর্যন্ত কেন বই তৈরি হলো না তা আমারও বোধগম্য নয়। আমি বছরখানেক হয় এখানে এসেছি। কালই আমি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ ব্যাপারে চাহিদা তৈরি করতে বলব। আগামী বছরই যাতে মণিপুরীসহ প্রধান কয়েকটি গোষ্ঠীর শিশুরা নিজ ভাষায় বই পায় সে চেষ্টা করব।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার বাইরে সবচেয়ে বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস সিলেট অঞ্চলে। এই বিভাগে প্রায় ৩৭টি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে চা বাগানেই রয়েছে ২৫-২৬টি জনগোষ্ঠী। তবে সিলেটের ৩৭ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন পর্যন্ত দু-তিনটি ছাড়া আর কারোরই সরকারিভাবে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ মেলেনি। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা অবশ্য ক্ষুদ্র পরিসরে এ চেষ্টা চালাচ্ছে।

সিলেটের একটি প্রাচীন জনগোষ্ঠী পাত্র সম্প্রদায়। সিলেট দিল্লির সুলতানের আওতায় যাওয়ার আগে সর্বশেষ রাজা গৌড় গোবিন্দও ছিলেন এই সম্প্রদায়ের। তবে সাম্প্রতিক সময়ে একেবারেই কোণঠাসা অবস্থায় আছে এই জনগোষ্ঠীর বাসিন্দারা। দারিদ্র্য, জমি দখলসহ নানা কারণে বেশিরভাগই দেশ ছেড়েছে। তারপরও সিলেট অঞ্চলে টিকে আছে প্রাত্র সম্প্রদায়ের প্রায় চার হাজার মানুষ। তাদের ভাষার নাম ‘লালেনটার’। কিন্তু সরকারি এই উদ্যোগে পাত্র সম্প্রদায়ের শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের কোনো উদ্যোগ নেই।

তবে পাত্র সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষদ (পাসকপ) নামে একটি সংগঠন নিজ উদ্যোগে তিনটি কমিউনিটি স্কুল স্থাপন করেছে। সেখানে পাত্র সম্প্রদায়ের শিশুদের লালেনটার ভাষা শেখানো হয়।

পাসকপ সভাপতি গৌরাঙ্গ পাত্র নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নিজেদের বর্ণমালা নেই। তাই বাংলা হরফে আমরা নিজেদের ভাষায় বই তৈরি করেছি। আমাদের ভাষা শেখানোর জন্য সিলেট সদর ও জৈন্তাপুর উপজেলায় তিনটি কমিউনিটি বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছি। সেখানে পাত্র শিশুরা লালেনটার ভাষা শিখতে পারে। তবে সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এই কাজ দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’

সিলেট বিভাগে খাসিয়া সম্প্রদায়ের প্রায় ৩০ হাজার লোকের বাস। বিভাগে ৭৫টি পুঞ্জি রয়েছে খাসিয়াদের। সিলেটের সীমান্ত লাগোয়া ভারতের খাসিয়া অধ্যুষিত রাজ্য মেঘালয়। সেখানে খাসি ভাষার বইপুস্তক রয়েছে। তবে এখানে এখনো বাংলায়ই পড়তে হয় খাসিয়া শিশুদের। ফলে নিজ ভাষা শিখতে পারছে না খাসিয়া শিশুরা।

খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের প্রচার সম্পাদক সাজু মারচিয়াং এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমাদের শিশুরা খাসি ভাষায় কথাই বলতে পারে না। কারণ এই ভাষা শিক্ষার তেমন সুযোগ নেই। বিভিন্ন খাসিয়া পুঞ্জিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্বারা পরিচালিত কমিউনিটি বিদ্যালয়ে খাসি ভাষা শেখানোর কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা যৎসামান্য।’

সিলেটের ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক অবস্থানে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মণিপুরী সম্প্রদায়। সংখ্যার দিক দিয়েও তারা বেশি। মণিপুরী ভাষা ও সংস্কৃতির রয়েছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। নিজস্ব লিপিও রয়েছে তাদের। পণ্ডিত অতোম্বাপু শর্মা’র মতে, মণিপুরী ভাষার বয়স অন্যূন সাড়ে তিন হাজার বছর।

প্রতিবেশী ভারতের সংবিধানেও মণিপুরী ভাষা অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বাংলাদেশে সে স্বীকৃতি নেই। সরকারি উদ্যোগে মণিপুরী ভাষার বইও ছাপা হয়নি এখন পর্যন্ত। ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত মণিপুরী শিশুরা।

সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে মণিপুরী প্রভাত প্রতিম সিংহ সঙ্গীত। নিজেদের ভাষা বলতে পারলেও পড়তে ও লিখতে পারে না সে।

এ প্রসঙ্গে সঙ্গীতের বাবা সংগ্রাম সিংহ বলেন, ‘শেখার কোনো সুযোগ না থাকায় আমার ছেলে নিজের মাতৃভাষাও পড়তে পারে না। এটা যে কত কষ্টের, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না।

‘এনজিওদের উদ্যোগে মণিপুরী ভাষা শেখার কিছু প্রতিষ্ঠান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে রয়েছে। তবে এগুলো দাতাদের ফান্ডনির্ভর। ফান্ড শেষ হলে স্কুলের কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।’

‘মণিপুরী ল্যাংগুয়েজ সেন্টার’ নামে কমলগঞ্জে মণিপুরী ভাষা শিক্ষার তিনটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (একডো)।

প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক লক্ষ্মীকান্ত সিংহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকলেও সরকারিভাবে বেশির ভাগ ক্ষৃদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেই। ২০১৫ সাল থেকে আমরা তিনটি স্কুল পরিচালনা করছি। আমরা নিজেরাই বই ছাপাই।

‘বইপুস্তক তৈরির জন্য দক্ষ মানুষ পাওয়া যায় না। মণিপুরী ছাড়া এখানকার অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর ভাষার বর্ণমালাও নেই। শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। ফলে এই কার্যক্রম চালানো খুবই দুরূহ।’

সিলেটের চা বাগানগুলোয় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রায় তিন লাখ মানুষ। তাদের একসঙ্গে চা-জনগোষ্ঠী বলা হলেও তারা সবাই এক জাতি-গোষ্ঠীর নয়। চা বাগানসংশ্লিষ্ট জনপদে ২৪ থেকে ২৫টি ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর বাস বলে জানা গেছে। তবে তাদের কারোরই ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাদের ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও নেই।

শিক্ষা ও ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় চা জনগোষ্ঠীর অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে বলে জানান মিন্টু দেশেয়ারা। এই জনগোষ্ঠীর তরুণ মিন্টু কাজ করেন একটি ইংরেজি দৈনিকে। নিজে দেশওয়ালি জনজাতির বলে জানান তিনি।

মিন্টু বলেন, ‘ভাষা শিক্ষার তো ব্যবস্থা নেই-ই। এমনকি সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেই। ফলে অনেক ভাষাই এখন বিলুপ্তির পথে। উচ্চারণগত ভিন্নতার কারণে চা বাগানের বাসিন্দারা ভালো বাংলা বলতে পারে না। আবার তাদের নিজস্ব ভাষারও স্বীকৃতি নেই। ফলে বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে। এ কারণে এই জনগোষ্ঠী বাগান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।’

ভাষার বর্ণমালা না থাকলেও বই প্রকাশে কোনো সমস্যা নেই বলে মনে করেন মণিপুরী ভাষার কবি এ কে শেরাম। তিনি বলেন, ‘দেশের মধ্যে মণিপুরী, রাখাইন, চাকমা, সাঁওতাল- এরকম পাঁচ-ছয়টি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বর্ণমালা আছে। বাকিদের কেউ বাংলা আবার কেউ ইংরেজি বর্ণমালায় নিজেদের ভাষায় লিখে। যেমন খাসিয়ারা ষেখে ইংরেজি বর্ণমালায়। ফলে বাংলা বা ইংরেজি বর্ণমালা ব্যবহার করেও স্ব স্ব ভাষার বই প্রকাশ করা যায়।

‘সব শিশুকে মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানে সরকারের ঢিলেমি রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।’

মাতৃভাষায় শিশুদের শিক্ষালাভের গুরুত্ব উল্লেখ করে শিক্ষাবিদ ডক্টর আবুল ফতেহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিশুরা জন্মের পর মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা শোনে সেই ভাষায়ই তার স্বপ্ন বোনে। কিন্তু এই ভাষাটা যদি সে না শিখতে পারে, তবে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। সে অন্ধকারে হাতড়াতে থাকে।

‘কেউ মাতৃভাষাটা ভালো করে শিখলে তার জন্য অন্য ভাষা শেখাটা সহজ হয়ে যায়। তাই সব শিশুর এই সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।’

এ বিভাগের আরো খবর