যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস পালনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি।
শহীদ মিনারের মূল বেদিসহ পুরো প্রাঙ্গণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করাসহ সৌন্দর্যবর্ধন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। শনিবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরেজমিন এমন চিত্র দেখা গেছে।
সৌন্দর্য বাড়াতে শহীদ মিনারসহ আশপাশের রাস্তার দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা মিনার প্রাঙ্গণ আলপনা এঁকে রঙের তুলিতে সাজিয়ে তুলছেন। দেয়ালে দেয়ালে ফুটিয়ে তুলছেন বর্ণমালা।
আঁকা হচ্ছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা কবি-মনীষীর নানা পঙক্তি-উক্তি। শহীদ মিনারের বিপরীত পাশের দেয়ালগুলোয় রঙের আঁচড়ে আঁকা হচ্ছে বাহান্ন থেকে একাত্তরের গৌরবগাথা এবং উত্তাল দিনগুলোর চিত্রকর্ম।
অন্য বছরের মতো এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনের তত্ত্বাবধানে অনুষদটির শিক্ষক এবং বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা এ কাজে অংশ নিয়েছেন।
আলপনা আঁকার কাজে সহায়তা করা চারুকলা অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থী শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কাজটি চারটি ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে প্রায় ৫০ জন করে কাজ করছেন। ভাগগুলো হলো বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে পেইন্টিং, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বিভিন্ন কবির কবিতার পঙক্তি, শহীদ মিনারের বেদিতে আলপনা, জিমনেশিয়ামের বিভিন্ন গেটের কাজ আর রাস্তায় আলপনা।
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি লেখাটি প্রতি বছরের মতো এ বছরও চারুকলার প্রিন্টিং বিভাগের শিশির ভট্টাচার্য স্যার আঁকছেন। সব কাজই মূলত ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। তবে কোথাও আগে বা পরে শুরু হয়। মোটামুটি রোববার পর্যন্ত এসব কাজ চলবে। আর রোড আলপনার কাজটি রোববার সকাল থেকে শুরু হবে। ’
শহীদ বেদির আলপনায় তুলির শেষ আঁচড় দিচ্ছেন চারুকলা অনুষদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী অর্পিতা দেবনাথ মিথু। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই চারুকলার শিক্ষার্থীরা আলপনা আঁকেন। এবার আমরা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরাই আলপনা আঁকছি।’
প্রাচ্যকলা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মো. তাসনিমুল ইজাজ বলেন, ‘চারুকলা অনুষদে আটটি বিভাগে আমরা প্রথম বর্ষের প্রায় ১৩৫ জন শিক্ষার্থী আছি। মোটামুটি সব শিক্ষার্থীই এ কাজে অংশগ্রহণ করেছেন।’
এদিকে শহীদ মিনারের চারপাশে আলোকসজ্জার ব্যবস্থা এবং পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। পাশেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ছাদে ঘোষণা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ প্রাঙ্গণে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কন্ট্রোল রুম, ফায়ার সার্ভিস ও প্রাথমিক চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস সুষ্ঠুভাবে পালনের লক্ষ্যে গত ২৩ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটিসহ ১৪টি উপকমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি ও উপকমিটিগুলোর যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জানিয়েছেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রতিটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন প্রতিনিধি এবং ব্যক্তিপর্যায়ে একসঙ্গে সর্বোচ্চ দুজন শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারবেন। শহীদ মিনারে আগত সবাইকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরতে হবে। এ ছাড়া তিনি সবাইকে টিকা সনদ সঙ্গে রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন।
প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রে অতিথিদের জন্য অভ্যর্থনার ব্যবস্থা থাকলেও এ বছর পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় তা থাকছে না বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান সার্বিক প্রস্তুতি সরেজমিন দেখার জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শন শেষে উপাচার্য সার্বিক প্রস্তুতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রাচার অনুযায়ী একুশের প্রথম প্রহরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদিমূল প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং যথাসময়ের মধ্যেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।’
উপাচার্য আখতারুজ্জামান চলমান করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০২২ উদযাপনের জন্য সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও আজিমপুর কবরস্থানে যাতায়াতের জন্য একটি রুট-ম্যাপ দেয়া হয়েছে। তা যথাযথভাবে অনুসরণ করার জন্যও উপাচার্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান।
দিবসটি পালনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৬টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে সীমিত পরিসরে একটি প্রভাতফেরি বের করা হবে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান প্রভাতফেরিতে নেতৃত্ব দেবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট-সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতে অংশ নেবেন। প্রভাতফেরি সহকারে তারা আজিমপুর কবরস্থান হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাবেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।
এ ছাড়া বাদ জোহর বা সুবিধাজনক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদুল জামিয়া, সব হলের মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাষাশহীদদের রুহের মাগফিরাত বা শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত বা প্রার্থনা করা হবে।