গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালে করোনা টিকা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের যারা লাঠিপেটা করেছে তাদের খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসক।
তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির প্রধান করা হয়েছে জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিষ্ট্রেট রাম কৃষ্ণ বর্মনকে। বাকি দুজন হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. ফিরোজ জামান জুয়েল ও আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার রাকিবুল হাসান চয়ন।
ঘটনার দিন সন্ধ্যায় এই কমিটি গঠন করে ৩ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মাহাবুবুর রহমান।
এদিকে টিকা কাজে নিয়োজিত রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবীদের বিরুদ্ধে লাঠিপেটার অভিযোগ উঠলেও তারা তা অস্বীকার করে আসছেন শুরু থেকে।
স্বেচ্ছাসেবীদের অন্যতম রুবেল হোসেন বলেন, ‘গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা টিকার কাজে সহযোগিতা করছি। কোনোদিন এমন ঘটনা ঘটেনি। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। জড়িত থাকলে আমাদেরও শাস্তি দাবি করছি।’
লাঠিপেটার সঙ্গে কোনো যোগসূত্রের কথা অস্বীকার করেছেন স্বেচ্ছাসেবী রাকিব হাসানও। তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সবার গায়ে রেড ক্রিসেন্টের জ্যাকেট থাকে। যে সময় শত শত শিক্ষার্থী ছুটোছুটি করে আহত হয়ে মাটিতে পড়েছিল তখনও রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী মারুফ আহতদের উদ্ধার করছিল।’
স্বেচ্ছাসেবী মারুফ ইসলাম বলেন, ‘আমি সেদিন সকাল সাড়ে ৮টায় টিকা কেন্দ্রে যাই। আমি সহ স্বেচ্ছাসেবী হুমাইরা ও আদিব গেইটে দায়িত্ব পালন করছিলাম। ১০টার পরপরই হাজার হাজার শিক্ষার্থী টিকা নিতে আসে। আমরা লাইনের শৃঙ্খলতা ফেরাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। সবাই ঠেলাঠেলি করে ভেতরে ঢুকতে চাইছিল। এ সময় টিকা নিতে আসা স্থানীয় সরকার পাড়ার কয়েকজন ছেলে নিজে থেকে লাইন সোজা করতে শিক্ষার্থীদের ধাক্কাধাক্কি করছিল। তখন কয়েজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের বাগ্বিবিতণ্ডা শুরু হয়।’
মারুফ জানান, বাগ্বিতণ্ডার এক পর্যায়ে সরকার পাড়ার ছেলেরা পাশের নির্মাণাধীন ভবন থেকে বাঁশ নিয়ে দৌড়ে আসেন। এ সময় লাইনে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরা ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন। এতে কয়েকজন ড্রেনে ও রাস্তায় পড়ে আহত হন। স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের উদ্ধারকাজে অংশ নেন। পরে পুলিশ এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে এগিয়ে যান রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবী মারুফ
তবে হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত আড্ডা মারেন সরকার পাড়ার এমন কাউকেই সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে সরকার পাড়ার বাসিন্দা এমদাদুল হক দাবি করেছেন, হামলাকারীদের কেউ ওই এলাকার নয়। তা ছাড়া হামলাকারীদের মুখে মাস্ক থাকায় ভিডিও ও ছবি দেখে তিনি কাউকে চিনতে পারছেন না বলেও জানান।
এদিকে এমন ঘটনায় নিন্দার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। টিকাকেন্দ্রে এমন বিশৃঙ্খলার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছে জেলার ছাত্র ও সুশীল সমাজ। যারা লাঠি হাতে আতঙ্ক ছড়িয়ে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তারা। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে চিহ্নিত ও আটক করা হয়নি।
কাউকে আটক না করার বিষয়টি স্বীকার করে ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি তানভীরুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।’
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা. নূর নেওয়াজ আহম্মেদ বলেন, ‘এটি একটি অনাকাঙ্খিত ঘটনা। বহিরাগতরা এসে এটি ঘটিয়েছে। তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। শিগগিরই জানতে পারবো কারা শিক্ষার্থীদের উপর চড়াও হয়েছিল।’
এদিকে হাসপাতালে প্রতিদিনই হাজার হাজার শিক্ষার্থী টিকা নিতে আসছেন। তবে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ তুলে নিজ নিজ বিদ্যালয়ে টিকা প্রদানের দাবি করেন টিকা নিতে আসা দানারহাট মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তানিশা মিম।
ইয়াসিন আলী নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘সেই সকাল ৯টায় এসেছি। এখন দুপুর ২টা। আজ হবে কি-না জানি না।’
টিকা প্রদান কাজে নিয়োজিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বেচ্ছাসেবী বলেন, ‘আমাদের কিছু করার নাই। এত শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ৬টা বুথে ১৯ জন মানুষ টিকা দিয়ে কাভার করা সম্ভব না। আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তাই এখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে।’
প্রত্যেক বিদ্যালয়ে টিকাকেন্দ্র চালুর বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘এটা করতে পারলে খুব ভালো হতো। কিন্তু টিকার গুণগত মান ঠিক রাখতে এটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ টিকা সংরক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কক্ষ প্রয়োজন। না হলে টিকা নষ্ট হয়ে যাবে।’
হাসপাতালের হিসাব সূত্রে জানা যায়, পুরো জেলায় ১ লাখ ৬২ হাজার ৫৫৯ জন শিক্ষার্থীকে করোনা টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১ লাখ ৫১ হাজার ৬৮৪ জন। দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন ৭৫ হাজার ৩৬৩ জন।