চার বছর ধরে থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে। পরিচয় দিতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। মাঝে মাঝে অংশ নিতেন ক্লাসেও। পরীক্ষার আগে বন্ধুদের সঙ্গে অংশ নিতেন গ্রুপ স্টাডিতে। সেমিস্টার ফাইনাল শেষের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরমাল ড্রেসে বন্ধুদের সঙ্গে তুলতেন ছবি। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষার্থীকে করেছেন বিয়ে। এত কিছুর পর জানা গেছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নন, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী।
প্রতারণার আশ্রয় নেয়া ওই শিক্ষার্থীর নাম নাইমুর রহমান। ফেসবুকে তার আইডির নাম বি এম নাইমুর রহমান নাইম। গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মধ্য বরিশালে।
নাইমুর নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীর পরিচয় দিতেন। বিজয় একাত্তর হলের যমুনা ব্লকের ৬০১১ নম্বর রুমের ‘ঘ’ নম্বর সিটে থাকতেন।
তবে এত দিনেও তার আসল পরিচয় জানতেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ‘সহপাঠী’ কিংবা হলের রুমের কেউ। চার বছর পর পরিচয় জেনে বিশ্বাসই করতে পারছেন না তাদের সঙ্গে এভাবে প্রতারণা করেছেন নাইম।
ঘটনা জানাজানি হলে নাইম তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন, অকার্যকর করে দেন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। নিজেও আত্মগোপনে চলে যান। তাই বিষয়টি নিয়ে তার বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নাইমের বন্ধু মোহাম্মদ ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমিসহ বিভাগের সবাই হতবাক। নাইম আমাদের সঙ্গে সব কাজে অংশ নিত। আমরা পরীক্ষা শেষে সাইকেল র্যালি করি, সেটাতেও থাকত, এমনকি পরীক্ষা-ভাইভাতেও। এখন মনে হচ্ছে সে দরজা পর্যন্ত গিয়ে আর পরীক্ষার হলে ঢুকত না। আর ভাইভাতে শুধু আমাদের সঙ্গে ছবিই তুলত, রুমে প্রবেশ করত না।’
ওই শিক্ষার্থী বলেন, তাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। প্রায় ২০০ জন। তাই সবার পরিচয় জানা সম্ভব হয় না।
তার বন্ধুদের ধারণা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে নাইম নামে এক ছাত্র ভর্তি হয়ে পরে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। যার সংযুক্তি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল। আর সে নাম নিয়েই নাইম হয়তো হলে উঠেছে।
প্রতারণার আশ্রয় নেয়া নাইমের নাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ফলাফলে পাওয়া যায়নি।
যেভাবে জানা গেছে নাইমের পরিচয়
চার বছর পর নাইমের আসল পরিচয় বের হওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের দুই বন্ধুর মনোমালিন্য। নাইম বিজয় একাত্তর হলের যে কক্ষে থাকতেন, সে কক্ষের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন থেকেই তারা কানাঘুষা শুনছেন নাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাইমের এক বন্ধু পড়ালেখা করেন। তাদের ভালো বন্ধুত্ব ছিল, সম্প্রতি তাদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়। এরপরই বের হয়েছে নাইমের প্রতারণার বিষয়টি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে কক্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ শকড। কয়েক বছর ধরে সে এই রুমেই থাকছে। ১৫ দিন থেকে সে রুমে নেই। খুব বিনয়ী এবং নম্র ছিল। আমরা ১৫ দিন আগে কানাঘুষা শুনতে পাই, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না। এরপর আমাদের রুমের কয়েকজন সদস্য হল অফিসে গিয়ে তার নাম চেক করে দেখে, নাম ঠিকই আছে, কিন্তু এই নামে কোনো বছরেই কোন ফি জমা হয়নি।
‘পরে আমরা রুমে এসে তার ড্রয়ার চেক করি। সেখানে কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট পাই৷ অ্যাসাইনমেন্টে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। তবে অ্যাসাইন্টমেন্টগুলো যে শিক্ষকের নামে সাবমিট করা সে নামে কোনো শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমরা খুঁজে পাইনি। পরে ঢাকা কলেজের ওয়েবসাইট চেক করে দেখতে পাই সে নামের শিক্ষক ঢাকা কলেজের।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আসলে এই ঘটনায় হল প্রশাসনের বড় একটি গাফিলতি রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের না হয়েও কীভাবে তার নামে সিট বরাদ্দ হয়। আর বরাদ্দ হলেও এত দিন কোনো ফি জমা হয়নি, সেটি দেখেও তাদের সন্দেহ হয়নি কেন? আমার মনে হচ্ছে এটার তদন্ত হওয়া দরকার।’
বিষয়টি নিয়ে বিজয় একাত্তর হলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কিছুদিন আগে সেই রুমের সদস্যরা হল অফিসে অভিযোগ জানিয়েছিল। আমরা বিষয়টি হল প্রাধ্যক্ষ এবং ফ্লোরটির সম্মানিত হাউস টিউটরকে জানিয়েছি। যাচাই-বাছাই না করে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। রোববারে হল অফিস খুললে রেকর্ড দেখে বলা যাবে।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে ফ্লোরটির দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক ড. শাহ মিরানের মোবাইলে কল করা হলেও বন্ধ থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি।