ছোট অরিন, বয়স সবেমাত্র ৬-এ পড়েছে। এরই মধ্যে সে নিজের মায়ের ভাষা বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারে। কোনো ভাষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সে ইংরেজি শেখেনি। তার ইংরেজি শেখার গুরু ইউটিউব। এরই মধ্যে সে নিজের ইউটিউব চ্যানেলও খুলেছে। ইংরেজিতে কনটেন্ট তৈরি করে নিত্যদিনের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরছে।
অরিনের এ ভাষা শেখা নিয়ে খুশি তার মা আইরিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘সে তিন বছর বয়স থেকেই ইংলিশে ফ্লুয়েন্টলি কথা বলতে পারে। অথচ সে এত দিন একটি বাংলা মাধ্যম স্কুলেই পড়ালেখা করেছে। এই বছরই একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আমরা বাবা-মাসহ পরিবারের সবাই সব সময় কথা বলি বাংলায়।’
আইরিন মাহমুদ বলেন, ‘প্রথম প্রথম তো আমরা অবাক হয়েছি। দুই বছর থেকেই ইংরেজি দু-একটা শব্দ বলা শুরু করে। কোনটি কী অক্ষর তাও দেখিয়ে দিতে পারত। ইউটিউব দেখেই মূলত সে শিখেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সাহায্য করেছি। বিভিন্ন বিষয়ে শিশুতোষ বা বাচ্চাদের ইংরেজি কনটেন্টই তাকে দেখতে দেয়া হতো। গেমের প্রতি তেমন আসক্তি নেই। আমরা সেদিকে খেয়াল রেখেছি।’
শুধু অরিনই নয়, ডিজিটাল যুগে অনেক শিশুই এখন ডিজিটাল ফ্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের কারণে নতুন নতুন ভাষা শিখছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা ইংরেজি ও হিন্দি। তবে অনেকে জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষাও শিখছে। তারা নিজেদের সিলেবাসের অনেক কিছু শিখছে ইউটিউব দেখে। অনেক অভিভাবকও সন্তানদের শিক্ষা দেয়ার জন্য বেছে নিচ্ছেন ইউটিউবকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুরা পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে তিনটি ভাষা শেখার ক্ষমতা রাখে। তারা যে ভাষা শোনে, তা-ই শিখতে পারে দ্রুত। তারা ইউটিউব দেখে দেখেই ইংরেজি বিভিন্ন শব্দ শিখে যায়। আবার হিন্দি কার্টুন দেখে হিন্দিও শিখে ফেলে। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষমতা কমে যায়।
শিশুরা ব্যস্ত ডিজিটাল ডিভাইসে। ফাইল ছবি
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইংরেজি না জানা মানুষের চেয়ে ইংরেজিতে পারদর্শী মানুষের ভবিষ্যৎ উপার্জন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ে।
ঢাকার বাইরের অভিভাবকদের বেশির ভাগই শিশুকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে দিতে পারেন না। এ কারণে তারা শিশুদের ইংরেজিতে দক্ষতা নিয়ে আক্ষেপে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ন্ত্রিত ইউটিউব তাদের ভাষা শিক্ষার ভালো মাধ্যম হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, নতুন ভাষা শেখার জন্য সবচেয়ে উপযোগী বয়স হচ্ছে ১০ বছরের নিচে। কারণ এরই মধ্যে শিশুদের মাতৃভাষা শেখার পাশাপাশি উচ্চারণে মাতৃভাষার টান দেখা যায়। ফলে এরপর অন্য ভাষা শেখা ও সে ভাষার উচ্চারণ আয়ত্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের গেমের চেয়ে শিক্ষামূলক ইউটিউব কনটেন্টের প্রতি বেশি আকৃষ্ট করা যেতে পারে। এতে শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা বাড়ার সম্ভাবনাও থাকে। এতে যুক্ত হতে পারে শিক্ষামূলক কুইজ। তবে ইউটিউব ব্যবহারের ব্যাপারে অভিভাবকদের অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বাংলাটাও শিখছে ভালোমতো
ইউটিউবে শুধু অন্য ভাষাই নয়, মাতৃভাষা বাংলাও শিখে নেয় অনেক শিশু। অনেকে বাংলার বিভিন্ন বর্ণ ও ছড়া শিখছে ইউটিউব দেখে। বিশেষ করে বাংলায় শিক্ষণীয় নানা ভিডিও থেকে সমুচ্চারিত বিভিন্ন বর্ণের উচ্চারণের পার্থক্য তারা করতে শিখছে। বিশেষ করে যেসব মা-বাবা চাকরি করেন, তাদের সন্তানদের শেখার বড় জায়গা ইউটিউব।
দুই পেরিয়ে তিনে পড়েছে আবির। মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। তাই তার বেশির ভাগ সময় কাটে বাসায় দাদা-দাদির সঙ্গে। বয়স্ক দাদা-দাদির কাছ থেকেই আদুরে ভাষায় শেখে অ-আ-ক-খ কিংবা এ-বি-সি। নাতির আবদারে কিছু সময়ের জন্য মোবাইল দেখতে দেন তারা। দিন শেষে ক্লান্ত মা-বাবাও তেমন সময় দিতে পারেন না। তবে তারা বাংলায় বিভিন্ন ছড়া ও বর্ণমালার কনটেন্ট বের করে দেন সন্তানকে। আবিরও খুশি মনে একাই উচ্চারণ করতে থাকে আর দেখতে থাকে।
মা-বাবা দেখতে পান ছেলে বাংলার সব বর্ণ চিনতে পারে। এমনকি প্রায় একই উচ্চারণের বর্ণও আলাদা করে পড়তে পারে, চিনতে পারে। বাংলা ছেড়ে ইংরেজি বর্ণও চেনা শুরু করেছে আবির। একা একাই বলতে পারে বেশ কিছু বাংলা ও ইংরেজি ছড়া।
সাবধানও হতে হবে অভিভাবকদের
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের ইউটিউব দেখার ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সাবধান হতে হবে। কারণ এখানে অনেক ভিডিওতে বিজ্ঞাপনধর্মী ক্লিপ থাকে। এগুলোর অনেক কিছুই শিশুদের কোমল মনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
শিশুদের জন্য ইউটিউব কিডস নামে আলাদা ফ্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে ইউটিউব। এটি ব্যবহার করা সবচেয়ে নিরাপদ।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুজ্জামাান কামরুল বলেন, আসলে ইউটিউব-ফেসবুকের ভালো ও খারাপ দুই দিকই আছে। কিছু জিনিস ভালো। যেমন- কিভাবে কী করতে হবে, শিখতে হবে, কিছু আঁকতে হবে– তা ইউটিউবে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সৃজনশীল কাজও সে শিখতে পারে।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমার ছোট মেয়ে, সে ইউটিউব দেখে ইংরেজি ভাষা শিখেছে, হিন্দি ভাষা শিখে ফেলেছে। এখন জাপানি ভাষা শিখছে। এ ছাড়া কীভাবে কোনো কিছুর স্কেচ করতে হয়, ছবি আঁকতে হয়, শিশুরা সেসব শিখছে ইউটিউব থেকে।
‘তবে এর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। কোনো কিছুতে আসক্তি হলে তা ক্ষতিকর। কিছু জিনিস আছে খারাপ। একবার সেখানে ক্লিক পড়ে গেলে তারা বারবার দেখতে চাইবে। তবে এর জন্য পেরেন্টাল গাইডেন্স থাকতে হবে। অভিভাবকদের এদিকে নজর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, শিশুদের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে মা-বাবাকে সতর্ক থাকতে হবে। সরাসরি এসব ডিভাইস ব্যবহারে নিষেধ থাকা উচিত নয়। তবে ব্যবহারের মাত্রা ঠিক করে দিতে হবে, কতটা সময় শিশু এগুলো চালাতে পারবে। কখনই অপরিমিত মাত্রায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস চালাতে দেয়া উচিত নয়। কারণ এতে শিশুর চোখের ওপর চাপ পড়তে পারে এবং তাদের শারীরিক সমস্যা হতে পারে।
আরেক বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘ইউটিউবে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এখানে প্রসেসড ফিড থাকে। এখানে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। শিশু নিজের ভাষা থেকে শুরু করে ইংরেজি ভাষাসহ অনেক কিছুই শিখতে পারে। অনলাইনের এ যুগে শিক্ষার উপকরণ এখন আরও বেশি ডিজিটাল হবে।
‘কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আনপ্রসেসড ফিডও থাকে। সেখানে কোনো ফিড কেউ দিলে তাতে কে লাইক দিল, কে মেসেজ দিল, তা নিয়ে আসক্তির ঝুঁকি বেশি থাকে, যা তাদের নৈতিকতা বিকাশে বাধা হতে পারে।
‘তবে এখানে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ডিজিটাল এ যুগে ইউটিউব-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ইতিবাচক কাজে লাগিয়েই শিশুর বিকাশ ঘটাতে হবে। সন্তান যাতে ইউটিউবকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পারে, সে জন্য মা-বাবারও এসব টুলস সম্পর্কে জানতে হবে শিশুদের চেয়ে বেশি। শিশু অনেক কিছু জানে, যা আমরা জানি না। সন্তানের প্রয়োজনেই তাদের আগে শিখতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ল্যাপটপ মোবাইলে আসক্ত হয়ে শিশুরা ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তারা কারো সঙ্গে মিশছে না। এতে তাদের ভাবনার জগৎ সংকুচিত থেকে যাচ্ছে। তাই প্রযুক্তির পাশাপাশি শিশুদের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাদের ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে, খেলার মাঠে খেলতে নিয়ে যেতে হবে। সেই সঙ্গে ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার অভিভাবকদের জানতে হবে, সচেতন হতে হবে।