১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি দিনাজপুর শহরের মহারাজা স্কুলে মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হয়েছিলেন পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন আরও শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। পঙ্গু হন এদের অনেকেই।
এই ইতিহাস ধরে রাখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে ঐতিহাসিক স্থানটিতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের জন্য গত বৃহস্পতিবার অর্থ অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
দিনাজপুর গণপূর্ত বিভাগ জানায়, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মহারাজা গিরিজানাথ মাঠ প্রাঙ্গণের পশ্চিম প্রান্তেই মনোরম শৈলী, ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হবে।
এই স্থাপনার বাম পাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসংবলিত তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ, ব্ল্যাক গ্রানাইটের মেঝে, তার পাশে বাণী এবং সর্বডানে থাকবে মাইন বিস্ফোরণ ট্র্যাজেডির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
স্মৃতিস্তম্ভে এমনভাবে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে যেন রাতের বেলায়ও দূর থেকে পরিস্কার দেখা যায়। তা ছাড়া রাস্তার ধারের দিকে থাকবে মোটা গ্লাস, যেন কোনো পথচারী বাইরে থেকেই স্মৃতিস্তম্ভটি সম্পূর্ণ দেখতে পান।
এই স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেয়ার জন্য যে বেদি, সেখানেও থাকবে অনেকগুলো স্তম্ভ। এতে মনে হবে- মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনারা এখনও দণ্ডায়মান আছেন।
দিনাজপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কুতুব আল হোসাইন বলেন, ‘স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করতে ২ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা অনুমোদন হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ হবে।’
সরকারি বিধি মেনে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মার্চের মাঝামাঝি কিংবা শেষ সপ্তাহেই স্তম্ভ নির্মাণকাজ শুরুর আশা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আছে, বিজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর লুকিয়ে রাখা ও ফেলে যাওয়া গোলাবারুদ উদ্ধার করে দিনাজপুরের মহারাজা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধা ট্রানজিট ক্যাম্পে এনে জড়ো করতে থাকেন। এই ক্যাম্পে এসে সমবেত হন দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলোর প্রায় আট শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৭২ সালের ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সেখানে ঘটে যায় ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। উদ্ধারকৃত অস্ত্র বাংকারে নামানোর সময় অসতর্কবশত এক মুক্তিযোদ্ধার হাত থেকে একটি মাইন পড়ে যায়। এতে মাইনটি বিস্ফোরিত হয় এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই বিস্ফোরণ ঘটে বাংকারের গোলাবারুদ ও অস্ত্রভান্ডারে।
ভয়াবহ ও বিকট এই বিস্ফোরণে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ হয় মহারাজা স্কুল প্রাঙ্গণসহ এর আশপাশের এলাকায়। এতে পাঁচ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
সেদিন সকালের রোলকলে উপস্থিত ছিলেন ৭৮০ জন মুক্তিযোদ্ধা। দুর্ঘটনার আগে ৫০-৬০ জন ছুটি নিয়ে ক্যাম্প ত্যাগ করেছিলেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান চার শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। বিস্ফোরণে মুক্তিযোদ্ধাদের হাত-পা, মাথা অনেক দূর পর্যন্ত ছিটকে যায়।
দুর্ঘটনার পর শতাধিক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছিল দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল ও সেইন্ট ভিনসেন্ট মিশন হাসপাতালে। এদের মধ্যে পরে অনেকেই মারা যান।
দুর্ঘটনার পরের দিন শহরের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের অংশ জড়ো করে দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে শহীদদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুরের এক জনসভায় ৬ জানুয়ারির দুর্ঘটনাস্থলে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে ওই স্থানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও দিনাজপুর-৩ আসনের সাংসদ ইকবালুর রহিম এমপি।
এ বিষয়ে হুইপ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থায়নে দিনাজপুরবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মিত হলে আগামী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আলোকিত হবে এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারবে।’