বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সেই আগের রূপে আজমেরী ওসমান?

  •    
  • ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৯:৩০

৯ বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কিশোর ত্বকীকে হত্যার পর আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান পর্দার আড়ালে চলে যান। তবে তিনি আবার নারায়ণগঞ্জে দাপট দেখাচ্ছেন। তার অনুসারীরা একটি পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আজমেরী প্রকাশ্যে, তবু তাকে ধরছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

নারায়ণগঞ্জে আলোচিত কিশোর তানভীর মোহাম্মদ ত্বকী হত্যার তদন্ত চলাকালেই এই হত্যায় আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের সংশ্লিষ্টতার কথা জানায় র‌্যাব। তার কথিত টর্চার সেলে হানা দিয়ে রক্তমাখা শার্ট উদ্ধারের ঘটনাটি টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রচারও হয়।

তখন আত্মগোপনে আজমেরী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘোষণা দেয়, তাকে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।

সেই হত্যার পর প্রায় ৯ বছর ধরে প্রকাশ্যে নেই আজমেরী। কিন্তু দাপট কি কমেছে?

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একটি স্থানীয় দৈনিকে ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে আজমেরীর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেই পত্রিকা অফিসে একদল তরুণের হামলার পর শামীম ওসমানের ভাতিজার বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে।

এই হামলা চালানোর পর নারায়ণগঞ্জজুড়ে আবার আলোচনা হচ্ছে, আজমেরী কি আবার তার ত্রাসের পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চাইছেন?

যদি তার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়াই যায়, তাহলে আজমেরীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কেন গ্রেপ্তার করছে না- এমন প্রশ্ন আবার বড় হচ্ছে।

ত্বকী হত্যার খসড়া চার্জশিট নিয়ে এই সংবাদ প্রকাশের জন্যই সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকার অফিসে হামলা হয়

রাজধানী লাগোয়া বন্দরনগরে আজমেরীর পরিবারের প্রভাব কমলেও এখনও সেটি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তবে সদ্যসমাপ্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে-পরে ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো থেকে শামীম ওসমান অনুসারী নেতাদের সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ এই বার্তা দিয়েছে যে, ওসমান পরিবারের একাধিপত্য তারাও আর রাখতে চাইছে না। এর মধ্যে ‘সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা’য় এই হামলা হয়।

পত্রিকাটির সাংবাদিকরা অভিযোগ করছেন, হামলাকারীরা তাদের আজমেরীকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জন্য শাসাচ্ছিলেন। এ কারণেই এই হামলায় শামীম ওসমানের ভাতিজার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ জোরালো হয়েছে।

নাগরিক কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ধীমান সাহা জুয়েল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে তাদের নাকের ডগায় বসে আজমেরী ওসমান বাহিনী গণমাধ্যমের ওপর হামলা করার সাহস পায়। এর বাইরেও তারা নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। আমরা প্রশাসনকে বলতে চাই, আপনাদের মেরুদণ্ড সোজা রেখে এ শহরের সন্ত্রাসীদের ধরে বিচারের আওতায় আনুন।’

সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এ বি সিদ্দিক বলেন, ‘তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পত্রিকা অফিসে হামলা করে সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করতে চায়। ঘটনার কয়েক দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু হামলার নেতৃত্বকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কারণ আজমেরী বাহিনীকে থামানো না গেলে সামনে আরও বড় ঘটনা ঘটতে পারে।’

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ শহরে যারাই ত্বকী হত্যার বিচার চেয়েছে, তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, যাদের বিরুদ্ধে লিখেছে, তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ত্বকী হত্যার মামলার গ্রেপ্তার আসামি সুলতান শওকত ভ্রমরের আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যেহেতু আজমেরী ওসমানের নাম এসেছে, সেহেতু তাকে ও সহযোগীদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার শুরু করার দাবি জানাচ্ছি।’

পত্রিকা অফিসে হামলার ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা সবাই আজমেরীর অনুসারী। তবে মামলায় আজমেরীকে আসামি করা হয়নি।

সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক আজিজুল হক জানান, পত্রিকা অফিসে হামলা, ভাংচুর, সংবাদকর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি ও দেড় লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির অভিযোগে করা মামলাটি গত সোমবার ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ কারণে মামলার তদন্ত ও গ্রেপ্তারের বিষয়টি দেখবে জেলা গোয়েদা (ডিবি) পুলিশ।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিবি শাখা) জাহিদ পারভেজ নিউজবাংলাকে জানান, ‘হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা পলাতক রয়েছে তাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

ত্বকী হত্যার ঘটনায় র‌্যাবের খসড়া অভিযোগপত্র নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে চাষাঢ়ায় প্রেসিডেন্ট রোডে সিরাজ ম্যানশনের চারতলায় নারায়ণগঞ্জে স্থানীয় দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা অফিসে হামলা চালায় একদল যুবক।

অর্ধশতাধিক মোটরসাইকেলে পত্রিকা অফিসে গিয়ে সাংবাদিকদের হত্যার হুমকি দিয়ে সিসি ক্যামেরা ভাংচুর করে ডিভাইস নিয়ে যায় তারা। এ ঘটনায় ওই পত্রিকার সম্পাদক জাবেদ হোসেন জুয়েল সদর থানায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন।

সময়ের নারায়ণগঞ্জের প্রকাশক ও সম্পাদক জাবেদ আহমেদ জুয়েল বলেন, ‘সম্প্রতি ত্বকী হত্যা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। ১১ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের সেই প্রকাশিত খসড়া চার্জশিট নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশ হয়। কপিটি গণমাধ্যম কর্মীদের সরবরাহ করেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি। সময় নারায়ণগঞ্জ পত্রিকায় সেটি হুবহু তুলে ধরা হয়। এ কারণে পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়েছে আজমেরী ওসমানের অনুসারী।

আজমেরী প্রকাশ্যেই

ত্বকী হত্যায় আজমেরীর সম্পৃক্ততার কথা র‌্যাব জানিয়েছিল প্রকাশ্যেই। সে সময় তিনি কয়েক বছর আত্মগোপনে থাকলেও সম্প্রতি আবার প্রকাশ্যে এসেছেন।

আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান

২০১৮ সালের ২ ডিসেম্বর হারুন অর রশীদ নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেয়ার পর আজমেরী আবার এক বছরের জন্য উধাও হয়ে যান। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর হারুন বদলি হওয়ার পর তিনি আবার ফিরে আসেন।

২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শহরের আমলাপাড়া এলাকার বাচ্চু নামে এক ব্যক্তিকে মারধর ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আজমেরীর বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় মামলা হয়।

তখন পুলিশ আজমেরীর বাসায় অভিযান চালিয়ে তার দুই সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু তাকে না পাওয়ার কথা জানায়।

আজমেরী তার বাড়ি আল্লামা ইকবাল রোড (কলেজ রোড) থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে বের হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়কে ঘোরেন। সঙ্গে থাকে বেশ কিছু মোটরসাইকেল। গাড়িটি সড়কে চলার সময় বিকট শব্দে গান বাজানো হয়। তখন দূর থেকেই স্থানীয়রা বুঝতে পারে, আজমেরীর বহর যাচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আজমেরী কোনো পাড়া-মহল্লায় গেলে আগেই সেখানে অবস্থান করেন তার সহযোগীরা। তিনি গাড়ি থেকে নামার পর অন্যরা মাথা নিচু রাখেন। এটা অনেকটা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো।

ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, নগরীর গার্মেন্টসের ঝুট সেক্টরে আজমেরী ঘনিষ্ঠদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

আজমেরীর ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বর্তমানে নাছির শহরে বেশ পরিচিত। তিনিই পত্রিকা অফিসে হামলা মামলার প্রধান আসামি।

আগে নাছিরের অবস্থানে ছিলেন তরিকুল ইসলাম লিমন নামে একজন। গত বছর একটি মামলায় গ্রেপ্তারের পর জামিনে বের হয়, তবে তাকে আগের মতো দেখা যায় না।

ত্বকী হত্যায় সম্পৃক্ততার তথ্য

২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী শহরের শায়েস্তাখান সড়কের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। দুদিন পর শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়।

এ ঘটনায় মামলার পর গত আট বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন রিফাত বিন ওসমান, সুলতান শওকত ভ্রমর, ইউসুফ হোসেন লিটন, সালেহ রহমান সীমান্ত ও তায়েবউদ্দিন আহমেদ জ্যাকি। এরা সবাই আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠজন ও অনুসারী ছিলেন।

ত্বকী হত্যার পর থেকে প্রায় ৯ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জে বিচারের দাবিতে ধারাবাহিকভাবে কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে

ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।

হত্যার এক বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলন করে মামলার তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান জানান, আজমেরী ওসমানসহ ১১ জন ত্বকী হত্যায় অংশ নেন।

একটি খসড়া অভিযোগপত্র তৈরি করার কথাও জানান সেই র‌্যাব কর্মকর্তা। তবে গত আট বছরে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। গ্রেপ্তারও হয়নি আজমেরী।

যদি আজমেরীর সম্পৃক্ততা থাকবে, তাহলে কেন তাকে গ্রেপ্তার হয়নি এমন প্রশ্নে র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক তানভীর মোহাম্মদ পাশার কাছ থেকে জবাব পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, ‘চার্জশিট দেয়ার জন্য তদন্ত কর্মকর্তা কাজ করছেন। মামলাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় আমরা বিভিন্ন বিষয় খতিয়ে তদন্ত করছি, যাতে ঘটনার আগের ও পরের কারণগুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা যায়। ঘটনার সঙ্গে যার যার সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

কবে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হবে- এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমানের কাছে প্রশ্ন রাখলে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি হননি।

আজমেরীকে আইনের আওতায় না আনায় তিনি ও তার সহযোগীরা এখন আবার পেশিশক্তি দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন নারায়ণগঞ্জ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি মাহাবুবুর রহমান মাসুম। তিনি বলেন, ‘নগরীর পাড়া-মহল্লার রংবাজ, মাদক ও চাঁদাবাজি মামলার আসামিসহ যাদের নিজের রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তারা আজমেরীর সঙ্গে যোগ দেয়। তারা নানাভাবে ভয় দেখায় স্থানীয়দের। ব্যবসায়ীদের হুমকি দেয়া হয়।’

এ বিভাগের আরো খবর