দেখে বোঝার উপায় নেই, এটা কী। বোঝা যায়, জঙ্গলের ভেতর কিছু একটা আছে। আরও একটু এগোতেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হলো। জঙ্গলে ঘেরা পরিত্যক্ত একটি শহীদ মিনার।
এ মিনারের মনে করিয়ে দেয়ার কথা ভাষার কথা, ভাষার জন্য জীবন দেয়ার কথা। মনে করিয়ে দেয়ার কথা ভাষা আন্দোলনের এক গৌরবময় ইতিহাসের কথা।
যে মিনারে একসময় ভাষাশহীদদের স্মরণে চোখের জল পড়েছে, তা আজ পরিত্যক্ত। জঙ্গল আজ আঁকড়ে ধরেছে।
এ শহীদ মিনার ফরিদপুর সরকারি ইয়াছিন কলেজের। মিনারটি কলেজ ক্যাম্পাসের পশ্চিমের এক কোণে পড়ায় তাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের পূর্ব পাশে নারীদের কমনরুমের সঙ্গে নতুন একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে পুরোনো শহীদ মিনারটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও তার প্রতি আর কোনো সম্মান বা শ্রদ্ধা কাজ করে না কলেজ কর্তৃপক্ষের।
শুধু তা-ই নয়, মিনারটির পাশে সীমানা দেয়ালসংলগ্ন প্রধান সড়কে একটি খাবার হোটেল। তার যত ময়লা-আবর্জনা, সবই ফেলা হয় এই মিনারের পাদদেশে।
ফরিদপুর শহরের টেপাখোলায় অবস্থিত সরকারি ইয়াছিন কলেজ। এটির প্রথম প্রতিষ্ঠা ইয়াছিন মুসলিম হাই স্কুল নামে। এলাকার শিক্ষানুরাগী ইয়াছিন জমাদারের জমি ও অর্থ সাহায্যে এটির প্রতিষ্ঠা। সে সময় স্বল্পসংখ্যক মুসলমানই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণে এগিয়ে আসতেন। তাই ইয়াছিন জমাদারের মতো স্বল্পশিক্ষিত মানুষের পক্ষে এ ধরনের প্রয়াস ছিল অকল্পনীয়।
ইয়াছিন মুসলিম হাই স্কুল ১৯৬৮ সালে স্থানীয় জনগণ এবং শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্যোগে ইয়াছিন কলেজে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৭ সালে এটি সরকারি ইয়াছিন কলেজ, ফরিদপুর নামে পরিচিতি লাভ করে।
কলেজে বর্তমানে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী। শিক্ষক ৪০ জন। শিক্ষার্থীদের এইচএসসি এবং অনার্সের চারটি বিষয়ে পাঠদান করা হয়।
১৯৯৯ সালে কলেজে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। সেখানে শহীদ মিনারে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো। ২০১২ সালে কলেজের অফিস কক্ষের পাশে নতুন একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে পূর্বের শহীদ মিনার পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কলেজের অফিস কক্ষের পাশে নতুন শহীদ মিনার
কলেজের সীমানা দেয়ালসংলগ্ন বাসিন্দা এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাংবাদিক এহসান বকাউল রানা বলেন, ‘কষ্ট লাগে। আমি যখন কলেজে পড়েছি, তখনও এই মিনারেই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করার পর পুরোনোটির কোনো খোঁজ রাখেনি কর্তৃপক্ষ।’
কলেজে এসএসসিতে ভর্তি হতে আসা নতুন শিক্ষার্থী রায়হান রহমান বলেন, ‘এখানে তো জঙ্গল। তার মধ্যে যে একটি শহীদ মিনার আছে, তা বুঝতে পারিনি।’
৬১ বছর বয়সী কলেজের দারোয়ান মজিদ শেখ। প্রায় ৩০ বছর হলো চাকরির বয়স তার। তিনি বলেন, ‘কলেজের গেটের সামনেই শহরের বৃহত্তম গরুর হাট। প্রতি মঙ্গলবার এ হাট বসলে অনেক গরুর বেপারি ভেতরে ঢুকে ওই জঙ্গলে গিয়ে মলমূত্র ত্যাগ করেন। নতুন গেটের নির্মাণকাজ হচ্ছে তাই প্রবেশপথ খোলা।’
কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. ফজলুল হক খান বলেন, ‘আমাদের কলেজে দৃষ্টিনন্দন একটি নতুন শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেখানেই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।’
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শীলা রানী মণ্ডল বলেন, ‘পুরোনো শহীদ মিনারটি ছিল পুরোনো মডেলের। আর তা ছাড়া পুরোনো মিনারটি সামনে তিনতলা ভবন থাকায় তা ক্যাম্পাসের এক কোণে পড়ে গিয়েছে। আর সেখানে নতুন ছয়তলা ভবন পাস হয়ে গেছে। অচিরেই কাজ শুরু হবে। তবে সেটার পরিবর্তে কমনরুমের পাশে নতুন আধুনিক শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে ভাষা দিবসটি ঘিরে আমাদের পরিকল্পনা আছে পুরোনো মিনারটিকে পরিষ্কার করে রং করার।’