‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড, ডোন্ট ফায়ার! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।’
ঠিক এভাবেই ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের বাঁচাতে পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে বলিষ্ঠ কণ্ঠে চিৎকার করে বলেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। তখনই পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের নিশানা হন তিনি। গুলির পর বেয়োনেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রাক্কালে যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিয়েছিল তাদের অন্যতম একজন ড. শামসুজ্জোহা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার মৃতুর পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দিবসটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
আজ বৃহস্পতিবারও যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্ববিদ্যালয়ে দিবসটি পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষে শুক্রবার দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে তার মৃত্যুর অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেলেও দিবসটি ঘোষণা করা হয়নি জাতীয় পর্যায়ে। মর্যাদা পায়নি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন সময় ১৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস ঘোষণার দাবি উঠলে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে একজন শিক্ষক নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। এই যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অনুপম দৃষ্টান্ত ড. জোহা তার জীবন দিয়ে রেখে গেছেন।
‘ড. জোহা শহীদ হওয়ার পরে গণআন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। যার ফলে আইয়ুব খান এই আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির যে আন্দোলন সেটাকে তরান্বিত করেছিল ড. জোহা।’
জাতীয় দিবস ঘোষণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যত এমপি-মন্ত্রী এসেছে, তাদের সবার কাছেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ড. জোহার মৃত্যু দিবসকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু তারা রাজশাহীতে থাকতে আশ্বাস দিলেও ঢাকা গিয়ে ভুলে যান।
‘এর আরেকটি কারণ হিসেবেও আমার মনে হয়, রাজশাহী যেহেতু ‘পাদপ্রদীপের’ আলোর ভিতরে নয় এই কারণে ঢাকাকেন্দ্রিক যে প্রশাসন তারা এই দাবিটি মেনে নেয়নি। তবে যদি বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষক দিবস করতে হয়, তাহলে অবশ্যই ড. জোহার মৃত্যু দিবসকে করতে হবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজের আহবায়ক অধ্যাপক এম খলিলুর রহমান খান বলেন, ‘শহীদ ড. জোহার মৃত্যু দিবসকে জাতীয় শিক্ষক দিবস করা হোক এই দাবি প্রতিবছরই করা হয়। এই দাবিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির মাধ্যমেই আদায় করা প্রয়োজন। কারণ শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় দাবিটি এখন পর্যন্ত আদায় হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘দাবিটি বাৎসরিক। জোরালোভাবে কখনো সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয় না। যখন দিবসটি আসে তখনই শুধু দাবির কথা সামনে আসে। এই দাবির ‘ফলোআপ’ করা হয় না। শুধু এই দিন ফুল দিয়ে, বড় ব্যানার করে, প্ল্যাকার্ড দেখিয়ে দাবি কখনোই আদায় হবে না।’
এ দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষক সমিতিকেই ভূমিকা রাখতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক দুলাল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদরে সকলের দাবি এই দিনটিকে জতীয় শিক্ষক দিবস করা হোক। প্রতিবছরই সরকারের কাছে এই দাবি জানানো হয়। কিন্তু দাবিটি মন্ত্রী পরিষদ পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই এবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মাধ্যমে দাবিটি উত্থাপন করা হবে। তাহলে মন্ত্রী পরিষদ পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং দাবিটি আদায় হবে বলে আমার মনে হয়।’