পারিবারিক কলহের জেরে ২০০৫ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি শিশুপুত্রের সামনে স্ত্রীকে খুন করেছিলেন আশরাফ হোসেন ওরফে কামাল। সেটি গোপন করতে স্ত্রীকে ওড়না দিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন তিনি। ওই ঘটনায় ১২ দিন জেলে থেকে জামিনে বের হয়ে আত্মগোপনে যান কামাল। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে বেছে নেন সাংবাদিকতা পেশা।
সাংবাদিক ছদ্মবেশে ১৭ বছর পলাতক হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামালকে বৃহস্পতিবার রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে শুক্রবার দুপুরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, গত বছরের ২১ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি কামালকে গ্রেপ্তারের জন্য র্যাবের কাছে অনুরোধ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র্যাব।
র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলার কাগজে পাওয়া মোবাইল নম্বরের ভিত্তিতে বরিশালে একটি অভিযান চালানো হয়। মোবাইল নম্বরটি আসামির নামেই রেজিস্ট্রেশন, কিন্তু ব্যবহার করছেন অন্যজন। মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে জানা যায়, আসামি দীর্ঘদিন মোবাইল নম্বরটি ব্যবহার না করায় মোবাইল কর্তৃপক্ষ সিমটি অপর ব্যক্তির কাছে রিপ্লেসমেন্ট সিম হিসেবে বিক্রি করেছে। ফলে কামালকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
‘র্যাব সাইবার পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রেপ্তার কামালের ফুট প্রিন্ট শনাক্ত করে। এরপর মাঠ পর্যায়ে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করে। এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-১১-এর অভিযানে বৃহস্পতিবার রাতে সাভার এলাকা থেকে কামাল গ্রেপ্তার হন।’
নিহতের সঙ্গে কী ঘটেছিল
গ্রেপ্তার কামালকে জিজ্ঞাসাবাদ ও সংশ্লিষ্ট মামলার অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে র্যাব জানায়, ২০০৫ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় পারিবারিক কলহের কারণে শিশুপুত্রের সামনে স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন কামাল। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গোপন করতে নিহতের ওড়না গলায় প্যাঁচিয়ে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন তিনি। পরে কামাল প্রচার করতে থাকেন, তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র্যাব আরও জানায়, এ সংক্রান্ত অপমৃত্যুর মামলা হয়। মরদেহের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে ঘটনাটি সন্দেহজনক হওয়ায় আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়।
র্যার আরও জানায়, জেলে যাওয়ার ১২ দিন পর শ্বশুরের সহায়তায় জামিন পান কামাল। জামিন পাওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আত্মগোপনে চলে যান তিনি। এর পর থেকে কখনোই তিনি নিজ বাড়ি নোয়াখালী, কর্মস্থল, সন্তান ও আত্মীয়দের কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।
নিহতের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে কী ছিল
র্যাব জানায়, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে শ্বাসরোধে সানজিদা আক্তারকে হত্যা করা হয়েছে বলে উঠে আসে। সোনারগাঁ থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করে। ওই মামলার একমাত্র আসামি কামাল।
মামলার তদন্তে জানা যায়, সিলিং ফ্যানের নিচে খাট ছিল। সে খাটের ওপর থেকে সিলিং ফ্যানের উচ্চতা খুবই কম ছিল। এমন অবস্থায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়। কামাল তার স্ত্রী সানজিদাকে হত্যা করেছেন।
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, কামাল প্রায়ই তার স্ত্রী সানজিদা আক্তারকে মারপিট করতেন। সার্বিক তদন্তে সাক্ষ্যপ্রমাণে কামালের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সোনারগাঁ থানার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিচার শেষে মামলার পলাতক আসামি কামালকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়।
বিভিন্ন পত্রিকা ও প্রতিষ্ঠানে চাকরি
র্যাব জানায়, কামাল ১৯৯৮ সালে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে বি.কম (পাস) করে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর প্রতিষ্ঠিত সিমেন্ট কোম্পানিতে ২০০১ সাল থেকে চাকরি শুরু করেন। তিনি ২০০৩ সাল থেকে সানজিদাকে বিয়ে করে কোম্পানির স্টাফ কোয়ার্টারে থাকতেন।
ঘটনার পর কামাল ছদ্মবেশে আশুলিয়ায় বসবাস শুরু করেন এবং প্রথম স্ত্রীর ঘটনা গোপন করে আবার বিয়ে করেন। পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশাকে গ্রেপ্তার এড়ানোর ছদ্মবেশ হিসেবে বেছে নেন।
কামালকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, আশুলিয়া এলাকায় তিনি ২০০৬ সালে সাপ্তাহিক মহানগর বার্তার সহকারী সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ২০০৯ সালে তিনি আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে সংবাদ প্রতিক্ষণ পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।
কামাল ২০১৩-১৪ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ২০১৫-১৬ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সহ-সম্পাদক পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন তিনি।
আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের ২০১৬-১৭ মেয়াদে নির্বাহী সদস্য পদ লাভ করেন কামাল। ২০২০ সালে দৈনিক সময়ের বাংলা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন তিনি।
২০২১-২২ মেয়াদে আশুলিয়া প্রেস ক্লাবে ফের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করে হেরে যান কামাল। বর্তমানে তিনি আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সদস্য এবং স্বদেশ বিচিত্রা পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত।
র্যাবের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, এই দীর্ঘ সময়ে কামাল সংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন পোশাক কারখানা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। নিজে ‘কমপ্লায়েন্স সল্যুশনস’ নামের একট কনসালট্যান্সি ফার্ম খোলেন। ফার্মটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশ নিয়ে কনসালট্যান্সি করত।
তিনি আরও জানান, সাংবাদিকতা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ ও নজরদারি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবেন—এমন ধারণা থেকেই স্ত্রীকে হত্যার পরে এ পেশা বেঁচে নেন কামাল।