নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের মোহসিনা বেগম। ১৯৮৮ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। কিন্তু এক বছরের মাথায় যৌতুকের টাকার জন্য স্বামীর নির্যাতনের শিকার হন তিনি। একপর্যায়ে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেয়া হয় তার মুখ।
কয়েক বছর পর মোহসিনার মা তাকে আবার বিয়ে দেন। সেই সংসারেও সুখ হয়নি তার। দুই মেয়েকে রেখে আরেকটি বিয়ে করে মোহসিনাকে রেখে চলে যান স্বামী।
দুই দশকে নানা প্রতিকূলতা পার করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মোহসিনা। সংসার চালাতে বেছে নিয়েছেন কাপড় সেলাই। দুই মেয়েকে পড়াচ্ছেনও তিনি।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করায় ঢাকা বিভাগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
মোহসিনা বেগম বলেন, ‘আমার বাপ ছোটবেলায় মইরা গেছে। মায় কাম কইরা তিন ভাইবোনরে বড় করছে। ভাইয়েরা দিন আসিল তাই অল্প বয়সে আমারে বিয়া দিয়া দিসিল আমাগো গ্রামের পুলা জাকারিয়ার কাছে। বিয়ার পর যৌতুকের ল্যাইখা খালি মাইরধুর করছে।
‘এর ল্যাইগা আমি বাপের বাড়ি আইলে যাইতে চাইতাম না। একদিন ঘুমের মধ্যে ঘরের উপরের আড়ার ফাঁকা দিয়া আমার উপরে অ্যাসিড থ্যাইল্লা দিছে।’
‘হায়রে জ্বলনি’- অ্যাসিডে দগ্ধ হওয়ার দুঃসহ যন্ত্রণা এখনও ভুলতে পারেন না মোহসিনা। বলেন, ‘আমার মুখ আর মাথা পুইরা গেছে, পরে লগে লগে আমারে আড়াইহাজার হাসপাতালে লইয়া গেছে। ওই সময় মানুষ আছিল না আমারে ঢাকা লইয়া যাইব। পরে হেন থ্যাইকা বাড়িতে আনছে।’
সেলাই মেশিনে কাজ করছেন মোহসিনা। ছবি:নিউজবাংলা
৮-১০ বছর আগে ঢাকার বনানীতে একটা হাসপাতালে চিকিৎসা হয় মোহসিনার। অপারেশনের পর সেলাই মেশিনের কাজ শুরু করেন তিনি।
মোহসিনা বলেন, ‘দুইটা মেয়েরে পড়ালেখা করাছি, আমার বড় মাইয়াডারে বিয়া দিসি, ছোটডা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ছে। অহন মাদ্রাসায় পড়ে। তয় পুঞ্জি নাই অহন সংসার চালাইতে অনেক কষ্ট হয়।’
নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে মোহসিনা বলেন, ‘আগে গাউছিয়া থ্যাইকা কাপড় আইন্না এখানে বাইয়া এখানেই বেছতাম। এখন পুঞ্জি নাই। তাই আর বেচতে পারি না। অহন মাইনসের অল্প স্বল্প কাপড় বানাই। লগে পুলাপানের মজা (চকলেট) বেছি। পুঞ্জি থাকলে কাপড় বানায় বেচতাম, একটা মুদি দোকান দেয়ার চিন্তাও আছিল তয় টেহার ল্যাইগা করতে পারি না। অহন কোনোমতে সংসার চলে। কোনোমতে বাইচ্চা আছি, আমার ঘরে পানির কল নাই, অহনো মাইনসের বাড়ি থ্যাইক্কা পানি আইন্না খাই।’
মোহসিনাকে অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিলেন যিনি, তাকে তার এমন কর্মের সাজা ভোগ করতে হচ্ছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ নিয়ে বন্দি তিনি।
এ উপজেলার আরেক অ্যাসিডে দগ্ধ নারী হাসিনা আক্তার। ভাগ্য বদলেছে তারও।
বিয়েতে রাজি না হওয়ায় তাকে অ্যাসিডে ঝলসে দিয়েছিল এক যুবক। তারপর একটি এনজিওর সহযোগিতায় রাজধানী থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। জীবনের নানা সংগ্রামের পর চাকরি পেয়েছেন। করেছেন বিয়ে। ২০১৮ সালে তাকেও জয়িতা সম্মাননা দেয়া হয়।
হাসিনার চাকরি হয় উপজেলা ভূমি অফিসে। ছবি:নিউজবাংলা
হাসিনা বলেন, ‘২০০৪ সালে আমাকে বিয়ে করতে চাইছিল আবির হোসেন নামের এক যুবক। সে আমাকে বিয়ে করতে না পেরে অ্যাসিডে ঝলসে দেয়। একটা এনজিও ঢাকায় আমার চিকিৎসা করায়।
‘সেখানে আরও অনেক অ্যাসিডে দগ্ধ নারীরা ছিল। সেখানে পড়ালেখা শিখাইছে। কয়েক বছর পর বাড়িতে ফিরা আসি। এরপর আমার চাকরি হয় উপজেলা ভূমি অফিসে। এখন আমি এখানে চাকরি করতাছি।’
হাসিনার ওপর অ্যাসিড ছুড়ে মারা যুবকেরও পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তিনি এখন কারাগারে।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করায় এই দুই নারীকে জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা দিয়েছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। এখন শুধু গ্রামই নয়, জেলাজুড়ে পরিচিতি পেয়েছেন তারা।
আড়াইহাজার উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাসরিন সুলতানা বলেন, ‘নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা মোহসিনা আড়াইহাজারের প্রতীক। তার আর্থিক অবস্থা খুইব একটা ভালো না। তাকে আমাদের সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তার মতো আরও যারা আছেন তাদেরও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া প্রয়োজন।’
মোহসিনা, হাসিনার মতো এ জেলায় যারা অ্যাসিডে দগ্ধ নারী রয়েছেন তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিস।
তিনি বলেন, ‘যারাই অ্যাসিডে দগ্ধ বা সামাজিকভাবে নির্যাতিত, আমাদের কাছে তাদের তথ্য আসা মাত্রই আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। আড়াইহাজারের মহসিনা তার জীবনযুদ্ধে জয় হয়ে তিনি জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন। তার মতো অ্যাসিডে দগ্ধ যেসব নারী নারায়ণগঞ্জে রয়েছেন, তারা যদি মনে করেন তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাদের কর্মসংস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করব।’