৩৬ বছরের জীবন তার। এর মধ্যে শেষ আট বছরই কেটেছে শিকলে বাঁধা অবস্থায়।
এই কাহিনির পেছনে আছে পরিবারটির আর্থিক অসচ্ছলতা, মানসিক রোগের চিকিৎসা করতে না পারার আক্ষেপ।
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ ইউনিয়নের সিংসাড়া গ্রামের নুরুল হক প্রামাণিকের ছেলে এনামুল হক প্রামাণিকের জীবনটা আর দশজনের মতোই ছিল ২০১৪ সাল পর্যন্ত।
ওই বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠেন তিনি। স্বজন আর স্থানীয়রা ওই এলাকার এক কবিরাজের কাছে নিয়ে যান। সেই কবিরাজ দেন ঝাড়ফুঁক। হিতে হয় বিপরীত। আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন এনামুল।
এর মাঝে স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসে খাওয়ানো হয়েছে। কিন্তু সুচিকিৎসা আর হয়নি।
একবার অবশ্য চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু শেষ হয়নি। ২০১৪ সালের মার্চের দিকে নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের পরামর্শে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে কিছু ওষুধ লিখে দেয়া হয়।
ওষুধগুলো সেবনে কিছুটা সুস্থ হলেও তার এক মাস পর থেকে আরও বেশি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। অসুস্থতা বাড়তে বাড়তে পুরো নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে শিকলে বেঁধে রাখে পরিবারটি।
এনামুল কারণ ছাড়াই কখনও হাসেন, কখনও কাঁদেন আবার কখনও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেঁচি করতে থাকেন।
মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন মানুষটি এখন নিঃসঙ্গও। স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। বাবা পাশে নেই। তিনি এনামুলের মাকে তালাক দিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন।
২০১৪ সালের শেষ দিকে স্থানীয় এক ব্যক্তির এক খণ্ড জমিতে টিন ও মাটির তৈরি টালি ঘরে এনামুলকে নিয়ে থাকছেন মা রমিছা বিবি।
রমিছা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেক দিন ধরে পায়ে শিকল বেঁধে রাখার কারণে পায়ে পচন ধরে যায়। তখন আরেক পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হয়। ছেলেটির এমন করুণ অবস্থা দেখে বুকটা আমার ফেটে যায়। এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় আট বছর ছেলেটি আমার শিকলবন্দি। যেটুকু পেরেছিলাম চিকিৎসা করিয়েছিলাম। আর পারছি না চিকিৎসা করাতে। বয়স্ক ভাতা তিনবেলা ভাত খেতেই চলে যায়। কী করব বুঝতে পারছি না।’
বয়স হয়েছে। এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে- বিষয়টি মাথায় ঢুকেছে রমিছার। কিন্তু তিনি চলে গেলে ছেলেটির কী হবে- এই চিন্তা পেয়ে বসেছে তার।
রমিছা বলেন, ‘আমি মারা গেলে আমার এই পাগল ছেলেটির কী হবে, কে দেখবে তাকে? জীবিত থাকাকালীন ছেলেটিকে সুস্থ দেখে যেতে চাই।
‘যদি সরকার বা সমাজের বিত্তবান কেউ একটু চিকিৎসার জন্য সাহায্য করত, তবে ছেলেটি উন্নত চিকিৎসা পেলে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠত। করজোড় অনুরোধ, আমার ছেলেটির পাশে একটু দাঁড়ান’- বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রমিছা বিবি।
মোমেনা বিবি নামে স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, ‘বউ তো ছেড়ে চলে গেছে আট বছর আগে। বাবাও তার মাকে তালাক দিয়েছে। বৃদ্ধা মা ছেলেটির জন্য আর কত করবে?
‘ছেলেটি রাতে চিৎকার করে। সব সময় অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। কখনও কান্না করে, আবার কখনও হাসে। ছেলেটির এমন অবস্থা দেখে খুবই কষ্ট হয়।
‘আমরা প্রতিবেশীরা যেটুকু পারি সহযোগিতা করি। তবে ছেলেটির সুচিকিৎসার জন্য যদি সরকার একটু পাশে দাঁড়ায়, তাহলে হয়তো সুস্থ হয়ে উঠত।’বিষয়টি নিয়ে কথা হলে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইকতেখারুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। পাবনা মানসিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কথাও হয়েছে। সেখানে বর্তমানে সিট সংকট রয়েছে। আমরা চেষ্টা করব দ্রুত তাকে সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার।’