জেলিফিশকে ‘অমর’ বলেছেন অনেক গবেষক। অর্থাৎ সামুদ্রিক এই প্রাণীটির মৃত্যু নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের কুয়াকাটা ও কক্সবাজারসহ বিভিন্ন সৈকতের বালিতে জেলিফিশকে প্রায়ই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
এবার পটুয়াখালীর কয়েকটি চরে যেন জেলিফিশের মৃত্যুর মহামারি শুরু হয়েছে। স্থানীয়দের মতে, অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার বালিতে আটকে জেলিফিশের মৃত্যু অনেকাংশেই বেশি।
গত ১০ থেকে ১৫ দিন ধরে কুয়াকাটাসংলগ্ন চরবিজয়, জাহাজমারা আর সোনারচর সৈকতে মৃত অবস্থায় অসংখ্য জেলিফিশ দেখা গেছে।
সাগরে মাছ ধরায় নিয়োজিত একাধিক জেলে এবং মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মূলত ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে এসেই সৈকতের বালুতে আটকা পড়ে মরছে জেলিফিশগুলো।
বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা কুয়াকাটাসংলগ্ন নতুন চরবিজয়কে অনেকে ব-দ্বীপও বলেন। শীত মৌসুমে সাগরে মাছ ধরে এই চরেই মাছ বিক্রি করেন আবু হানিফ। কুয়াকাটার গঙ্গামতি এলাকার এই জেলে বলেন, ‘জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে চরে বসেই পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেই। তখন দেখা যায়, বেশ কিছু জেলিফিশও মাছের সঙ্গে আটকা পড়েছে। তখন আমরা সেগুলো চরেই ফেলে দেই।’
মাছের অপেক্ষায় দুই-তিন ঘণ্টা ওই চরে দাঁড়িয়ে থাকা পাইকার সোবাহান বলেন, ‘জোয়ারের সময় সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে অনেক জেলিফিশ ভেসে আসতে দেখি। স্রোতের টানে কিছু নেমে গেলেও অধিকাংশই বালুতে আটকে যায়। তখন প্রত্যেকটি জেলিফিশের চারপাশে সামান্য গর্তের মতো সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করেই জেলিফিশটি মারা যায়।’
জেলিফিশের একই ধরনের মৃত্যুর বর্ণনা দিলেন বরিশাল থেকে চরে ঘুরতে যাওয়া পর্যটক তাসকিন মাহমুদও।
স্থানীয়দের মতে, অন্য সময়ের তুলনায় এবার সৈকতে জেলিফিশের মৃত্যুর ঘটনা বেশি
উপকূলীয় জলজ প্রাণী নিয়ে কাজ করা কুয়াকাটার আবুল হোসেন রাজু বলেন, ‘কুয়াকাটা সৈকতের গঙ্গামতি, লেম্বুরবন, খাজুরা এলাকায় প্রায়ই জেলিফিশ মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সময়ভেদে এমনটি কমবেশি দেখা যায়। তাই এবার বেশি মৃত্যুর ঘটনা আশঙ্কাজনক কিছু নয়।’
মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, “নামে ‘ফিশ’ থাকলেও, মাছের মতো মেরুদণ্ড নেই জেলিফিশের। তাই এরা স্রোতের বিপরীতে চলতে পারে না। এ জন্য ঢেউয়ের তোড়ে সৈকতে চলে এলে এরা অনেক সময় ফিরে যেতে পারে না। বালুর সঙ্গে এর শরীর আটকে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়।”
বছরভেদে জেলিফিশ মৃত্যু কম-বেশি হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গভীর সাগরে লবণাক্ততা বেড়ে গেলে জেলিফিশরা সাধারণত কম লবণাক্ত এলাকায় ছুটে যায়। গভীর সমুদ্র থেকে লবণাক্ততা কম থাকায় এরা অনেক সময় উপকূলের দিকে ছুটে আসে। পরে ঢেউয়ের তোড়ে সৈকতের বালুতে আটকে এদের মৃত্যু ঘটে।’
হঠাৎ জেলিফিশের মৃত্যু বাড়ার বিষয়ে কামরুল ইসলাম জানান, শীত মৌসুমে সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় জেলেরা গভীর সাগরের তুলনায় উপকূলবর্তী এলাকায় বেশি জাল ফেলেন। তাদের জালেও জেলিফিশ ধরা পড়ে এবং জালের প্যাঁচেই অধিকাংশ মারা যায়। পরে জেলেরা সৈকতে জাল তুলে মাছগুলো পাইকারদের কাছে বিক্রি করলেও, জালে আটক জেলিফিশগুলো তারা সৈকতেই ফেলে দেয়।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ বলেন, ‘এটি আশঙ্কার কিছু নয়। তারপরও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।’
এবার প্রশ্ন আসতে পারে- বিভিন্ন সৈকতে অহরহ জেলিফিশ মরতে দেখা গেলেও এটিকে গবেষকরা ‘অমর’ প্রাণী বলেন কোন হিসেবে।
আমেরিকান মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টোরি’র তথ্যমতে, একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য জেলিফিশকে অমর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন গবেষকরা।
তাদের মতে, সত্যিকার অর্থেই নিজেকে অমর করে রাখতে পারে জেলিফিশ। মৃত্যুর কোনো আশঙ্কা থাকলে এরা নিজের বয়স কমিয়ে ফেলতে পারে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে গবেষকরা জানিয়েছেন, যদি কোনো জেলিফিশের শরীরের কোনো অংশে আঘাত লাগে, তবে এরা সঙ্গে সঙ্গে ‘পলিপ দশা’য় চলে যায়। চারপাশে মিউকাস মেমব্রেন তৈরি করে গুটি বাঁধে পলিপের আকারে। এই পলিপ অবস্থায় এরা তিন দিন পর্যন্ত থাকে। আর এভাবেই এরা বয়স কমিয়ে ফেলে।
এই সময়ের মধ্যে শরীরের সব কোষকে নতুন কোষে রূপান্তর করে জেলিফিশটি। এভাবেই বারবার রূপান্তরের মাধ্যমে এরা বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখে।
তবে, অন্য কোনো বড় মাছ এদের খেয়ে ফেললে কিংবা বড় কোনো রোগে আক্রান্ত হলে কিংবা সৈকতে আটকে যাওয়ার মতো কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে প্রায় সময়ই জেলিফিশের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে এদের মৃত্যু হয় না। অর্থাৎ দুর্ঘটনায় না পড়লে একটি জেলিফিশের চিরদিন বেঁচে থাকার ক্ষমতা রয়েছে।
এদিকে বংশবিস্তারের ক্ষমতাসম্পন্ন জেলিফিশগুলোকেই একমাত্র অমর বলে দাবি করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই জেলিফিশগুলো মূলত ভূমধ্যসাগর ও জাপানের সমুদ্রে দেখা যায়। জাপানের কিটো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই জেলিফিশ নিয়ে গবেষণা করছেন।