কর্ণফুলী টানেলের দুটি সুড়ঙ্গের ভেতরে রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। সমানতালে এগোচ্ছে পতেঙ্গা ও আনোয়ারা প্রান্তের ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ। সব মিলিয়ে প্রকল্পের ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের আশা, চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ হবে। সেই হিসাবে ২০২৩ সালে টানেল দিয়ে চলবে গাড়ি।
প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশিদ চৌধুরী বুধবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূল টানেলের দুটি সুড়ঙ্গের চারটি লেনে চলবে গাড়ি। সেগুলো চলাচলের উপযুক্ত করতেই এখন সুড়ঙ্গের অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণসহ বাকি কাজ চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে আনোয়ারা ও পতেঙ্গায় অ্যাপ্রোচ সড়কের কাজও দ্রুতগতিতে চলছে।’
ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প শেষ হবে আশা করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই ডেডলাইন মাথায় রেখে প্রতিদিন কাজ করছি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আমরা কাজ শেষ করতে বদ্ধপরিকর। আশার কথা হচ্ছে, এ পর্যন্ত একবারও এ প্রকল্পের মেয়াদ বা ব্যয় বাড়ানো হয়নি।’
টানেলের সুড়ঙ্গ খনন শেষ হয় গত বছর। প্রকল্পের সবশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী ইতোমধ্যে লেন স্ল্যাবের ঢালাই শেষ হয়েছে ২ হাজার ৪২৫ মিটার। আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্টের ডেক স্লাব ও পেভমেন্টের নির্মাণ শত ভাগ শেষ হয়েছে। টানেলের ভেতরে গাড়ি চলাচলের জন্য পিচঢালা সড়ক নির্মাণ ও ইউটিলিটি লাইন স্থাপনের কাজ চলছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ প্রকল্পে মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের জন্য কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে চারটি লেন থাকবে।
মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে সংযোগ সড়ক থাকবে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়াল সেতু।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কক্সবাজারের মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পর টানেলের গুরুত্ব আরও বেড়ে যাবে। মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার পর চট্টগ্রাম হয়ে যানবাহন এই টানেল দিয়ে সহজে চলাচল করতে পারবে। এতে দেশের অর্থনীতি দ্রুত বদলে যাবে।
কর্ণফুলী টানেলটি চট্টগ্রাম শহর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামকে যুক্ত করবে। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রাম শহরকে দুই ভাগ করেছে। এক ভাগে রয়েছে নগর ও বন্দর এবং অন্য ভাগে রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রাম।
টানেল দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী। নদীর ওপারে আরেকটি শহর গড়ে উঠবে। টানেল হলে চট্টগ্রাম হবে সাংহাইর মতো ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’।
চিটাগাং চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কর্ণফুলী টানেল দেশের অর্থনীতিতে পজেটিভ ইমপ্যাক্ট ফেলবে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মাতারবাড়ি ও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল আগামী দিনের দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এগুলোর উপযোগিতা বহুগুণ বৃদ্ধি করবে কর্ণফুলী টানেল।’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ একটি যুগোপযুগী সিদ্ধান্ত ছিল। নদীর নাব্যতা ও চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিগুলোতে সামুদ্রিক নৌযান চলাচলের কারণে আরেকটি সেতু করা সম্ভব হতো না। টানেল নির্মাণের ফলে আমরা অনেক সুবিধা পাব। এটি চট্টগ্রাম শহরকে পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করবে। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরে কমবে মানুষের চাপ।’
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার টানেল নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায়। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও চীনের সরকারি পর্যায়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়।
চীন সরকার এ টানেল নির্মাণের জন্য দেশটির প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেডকে দায়িত্ব দেয়। নকশা ও অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ হিসেবে চাইনিজ এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকার অর্থায়ন করছে। বাকি টাকা বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করছে।
নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।